বলেন কী?
একবার। থ্যাংকস গিভিং ডে–তে টার্কি কাটছিল, তখন আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হল। তোমার খালা তাঁর টেম্পার লুজ করে ছুরি হাতে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। পাঁচটা ষ্টিচ লেগেছে।
ও।
তুমি যেভাবে ও বললে তাতে মনে হল—আমার কথা বিশ্বাস করলে না। ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছিল। পুলিশি তদন্ত হয়েছে। আমেরিকান পুলিশের কাছে রেকর্ড আছে।
ও।
এইবারের ও টা আগের বারের চেয়ে ভালো হয়েছে। দ্বিতীয়বার খুনের চেষ্টা কী ভাবে করে তা তোমাকে বলতাম। দ্বিতীয়বারের চেষ্টাটা ছিল হাস্যকর ছেলেমানুষী চেষ্টা। কিন্তু হাতে সময় নেই। দশটা বাজে পুলিশ চলে আসবে।
পুলিশ কি কাঁটায়–কাঁটায় দশটার সময়ই আসার কথা?
আমার কথার জবাব দেবার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল।
আমি চমকে আরেফিন সাহেবের দিকে তাকালাম। পুলিশ না তো? আরেফিন সাহেব বললেন, পুলিশ না। পুলিশ। কখনো একবার বেল টেপে না। পৃথিবীর সবচে ভ্ৰদ্ৰ পুলিশ হল বৃটেনের পুলিশ। এরাও পরপর তিনবার বেল টেপে। যাও দরজা খোলো। আমার পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব না। আমার পা টলছে। পাঁচটা হুইস্কি খাওয়া ঠিক হয়নি। আমার লাস্ট লিমিট হচ্ছে চার।
আমি দরজা খুললাম। মালিহা খালা দাঁড়িয়ে আছেন। দুহাত ভর্তি ব্যাগ। বাজার করে ফিরেছেন বোধ হয়। খালা হাসি মুখে বললেন–তোকে বুদ্ধিমান ছেলে বলে জানতাম। তুই তোর খালু সাহেবের ফাঁদে এভাবে পা দিবি বুঝতেই পারিনি। দরজা ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন। একটু সরে দাঁড়া। আর মুখ থেকে জম্বি ভাবটা দূর কর তো।
আরেফিন সাহেব বললেন, কিছু মনে কোরো না হিমু তোমার সঙ্গে একটু প্রাকটিক্যাল জোক করলাম। তোমাকে দেখিয়ে–দেখিয়ে হুইস্কি বলে যা খাচ্ছি–তাও আসলে হুইঙ্কি না–জাষ্টি প্লেইন ওয়াটার। মানুষের সব কথা এমন চট করে বিশ্বাস করবে না। তবে মালিহা, তোমার এই Nephew কঠিন চিজ, আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস-করলেও ভড়কায়নি। টাইট হয়ে বসেছিল। I am impressed.
তর্ক হল আগুনের মত
আমার কি উচিত মানুষের সব কথা বিশ্বাস করা? তর্কে যাকে পাওয়া যায় না, তাকে পাওয়া যায় বিশ্বাসে। তর্ক হল আগুনের মত। যে-আগুনের কাছে এলে বিশ্বাস বাম্পের মত উবে যায়।
মালিহা খালার বাসা থেকে বের হলাম মন খারাপ করে। খালা এবং তার স্বামী দুজনে মিলে আমাকে বোকা বানিয়েছে মন খারাপটা সে কারণে না। অন্য কোনো কারণে, যা আমি ধরতে পারছি না। মাথার মধ্যে একই খটকা ঢুকে গেছে। অস্থির বোধ করছি। মনে হচ্ছে কোনো বড় ধরনের সমস্যা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। মন বসছে না। কোনো কিছুতেই মন বসছে না।
অস্থিরতা বিষয়ে আমার বাবা এলাৰ্জিক ছিলেন। পুত্রের প্রতি যে সব উপদেশ রেখে গেছেন তার একটি অস্থিরতা বিষয়ক।
কখনো কোনো অবস্থাতে অস্থির হইবে না। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘূর্ণায়মান। এই ঘূর্ণিতে তুমি কখনো অস্থিরতা পাইবে না। তুমি পৃথিবীর স্বভাব ধারণ করবে। মানুষ বাদ্য যন্ত্রের মত। সেই বাদ্য যন্ত্র নিয়ত সংগীত তৈরি করে। অস্থির বাদ্যযন্ত্র সংগীত সৃষ্টিতে অক্ষম। কাজেই তোমার জন্যে অস্থিরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইল। আমি জানি ইহা জগতের কঠিনতম কর্মসমূহের একটি। বাবা হিমু, কাউকে কাউকে তো কঠিনতম কর্মগুলি করিতে হইবে?
আমি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলাম। পকেটবিহীন পাঞ্জাবিগুলিতে আমি এখন বিরাট-বিরাট পকেট লাগিয়েছি। যখন চলাফেরা করি পকেট ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে চলা ফেরা করি। এই মুহুর্তে আমার পকেটে মোবাইল টেলিফোন ছাড়া আর যে সব জিনিসপত্র আছে তা হচ্ছে-–
১. একটা দেয়াশলাই।
২. সিগারেটের খালি প্যাকেট।
সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। প্যাকেটটা ফেলা হয়নি। পকেটে রেখে দিয়েছি।
৩. একটা মোমবাতি।
বড় সাইজের মোমবাতি। পাচ টাকা করে পিস। মোমবাতিটা খুব কাজে লাগে! রাতে কোনো বাসায় গিয়েছি, লোড শেডিং এর কারণে কারেন্ট চলে গেল। ওমি ম্যাজিসিয়ানদের মত পকেট থেকে মোমবাতি বের করলাম।
৪. এক শিশি আতর।
আতরের নাম মেশকাতে আম্বর। বিছমিল্লাহ হোটেলের মালিক দয়াল খাঁ উপহার হিসেবে আমাকে দিয়েছেন। অতি উৎকট গন্ধ। দয়াল খাঁ বলেছেন–বিশেষ–বিশেষ সময়ে এই গন্ধই অপূর্ব লাগে। বিশেষ সময় বের করার জন্যেই এই আতরটা দরকার।
৫. একটা হ্যান্ডবিল।
পিজি হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। বোরকা পরা এক মহিলা হাতে হ্যান্ডবিল ধরিয়ে দিলেন। অনেক মানুষের হাতে হ্যান্ডবিল ধরিয়ে দেবার কাজটা বোরখাপরা মহিলারা করেন না। ইনি করছেন দেখে ভাল লেগেছে বলে হ্যান্ডবিল রেখে দিয়েছি। হ্যান্ডবিলে জনৈক দেওয়ান কফিলউদ্দিন জানাচ্ছেন যে তিনি গ্যারান্টি সহকারে ক্যান্সারের চিকিৎসা করেন। হ্যান্ডবিলটা রেখে দিয়েছি। যদি কখনো সুযোগ হয় এই মহান চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলব।
পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করে আমি অপেক্ষা করছি। রাস্তা পার হয়ে একজন আমার দিকে আসছেন। তাঁর হাঁটার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে তাঁর পকেটে সিগারেট আছে কিন্তু দেয়াশলাই এর অভাবে ধরাতে পারছেন না। খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে নিশিরাতে যারা চলাফেরা করে তাদের বেশির ভাগের সঙ্গেই দেয়াশলাই বা লাইটার থাকে না।
ব্রাদার আগুন হবে?
আমি দেয়াশলাই দিলাম। তিনি সিগারেট ধরালেন। বিচারকের মত দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন। আমিও তাঁকে দেখলাম। মুখে হালকা বসন্তের দাগ। ছোট–ছোট চোখ। আশ্বিন মাস হলেও, চাদর গায়ে দেয়ার মত শীত না। কিন্তু তিনি বেশ ভারী একটা চাদর গায়ে দিয়ে আছেন। ভদ্রলোক দেয়াশলাইটা নিজের পকেটে রেখে কিছুই হয়নি ভঙ্গিতে যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে রওনা হলেন। আমি তাকে বললাম না, ভাই দেয়াশলাইটা ফেরত দিয়ে যান। ঢাকা শহরের রাত্রের রাস্তায় কিছু মানুষ চলাফেরা করে যাদের কখনোই কিছু বলতে হয় না। তবে এরা আরেকটু রাত করে নামে, ইনি সকাল–সকাল নেমে পড়েছেন। ট্রাকের পেছনে সাবধানবাণী থাকে একশ হাত দূরে থাকুন। এদের গায়ে কোনো সাবধানবাণী লেখা থাকে না তারপরও এদের কাছ থেকে পঁচিশ হাত দূরে থাকতে হয়।