আরেফিন সাহেব চশমা ঠিক করতে করতে ময়ুরের গল্পের শেষ অংশ শুরু করলেন। যদিও আমি খুব ভাল করে জানি— এটা শেষ না। শেষের পরেও থাকবে পরিশিষ্ট। পরিশিষ্টের পরে থাকবে উপসংহার। পুনশ্চের পিঠে পুনশ্চ।
নাচ শেষ করে পুরুষ ময়ুর চারদিকে তার স্পার্ম ছড়িয়ে দেয়। এবং সেই স্পার্ম খুঁটে খুঁটে খায় স্ত্রী ময়ূর। এবং এর ফলে ময়ূরী গর্ভবতী হয়। ইন্টারেস্টিং না?
আমি বললাম, মোটেই ইন্টারেস্টিং না। ওয়াক থুইং।
ওয়াক থুইং মানে?
ওয়াক থুইং মানে— ওয়াক থু।
তুমি কি সবসময় এমন ফানি ভঙ্গিতে কথা বলো?
চেষ্টা করি। সবসময় পারি না।
আমার মনে হয় সবসময় ফানি হবার চেষ্টা করা ঠিক না। এতে তোমার মধ্যে জোকার–ভাব চলে আসবে। তুমি সবাইকে হাসাবার একটা দায়িত্ব বোধ করতে থাকবে। একটা পর্যায়ে তোমার পার্সোনালিটি কলাপস করবে। আমার ধারণা এখনি করেছে।
আমি আলোচনার মোড় ঘুরাবার জন্যে বললাম, খালা কি বাসায় নেই?
বাসায় আছে। তাকে কীজন্যে দরকার বলো।
এক কাপ চা খেতাম।
কফি হলে চলবে?
চলবে।
এই মুহূর্তে তোমার খালার সঙ্গে দেখা হবে না। অপেক্ষা করতে হবে। তোমার কফি আমি বানিয়ে আনছি। চিনি ক চামচ খাও?
আমার কোনো ফিক্সড ব্যাপার নাই। যে যা দেয়। তাই খাই।
Again you are trying to be funny. Please dont do that.
আরেফিন সাহেব আমার জন্যে কফি আনতে গেলেন। আমার ধারণা কফি নিয়ে এসেই ময়ুর-বিষয়ক গল্পের পরিশিষ্ট শুরু করবেন। ঠাণ্ডা কফিতে চুমুক দিতে দিতে আমাকে গল্পের পরিশিষ্ট শুনতে হবে। ঠাণ্ড কফি— কারণ পুরুষমানুষ যখন চা বা কফি বানায় তখন সেই চা–কফি সবসময় ঠাণ্ডা হয়, চিনি বেশি হয়। এবং সেই চা বা কফিতে একটা পুরুষপুরুষ গন্ধ থাকে।
আরেফিন সাহেব (তাকে সাহেব বলা ঠিক না, আমার বলা উচিত খালু। আরেফিন খালু। আরেফিন নামটাকে শর্ট করে আরো–খালু বললেও খারাপ হয় না।)। মগ ভর্তি কফি আমার সামনে রাখতে রাখতে বললেন, বাই এনি চান্স আজ সারাদিনে কি তোমার খালার সঙ্গে তোমার কোনো কথা হয়েছে?
আমি বললাম, হয়েছে।
ঠিক কখন কথা হয়েছ বলো তো?
এগজ্যোক্ট সময় বলতে পারব না। প্রথমবার কথা হয়েছে সন্ধ্যার দিকে। বাংলাদেশে বাস করি তো, সারাক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকা আমাদের নিষেধ আছে।
দ্বিতীয়বার কখন কথা হল?
প্ৰথমবারের ঘণ্টা খানিক পর।
তার কথাবার্তা তোমার কাছে কি অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল?
না।
সে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে?
জ্বি।
কেন আসতে বলেছে সেটা কি ব্যাখ্যা করেছে?
না। শুধু বলেছেন–খুব জরুরি কথা আছে। আমার ধারণা জরুরি কথা টথা কিছু না, নতুন ধরনের কোনো খাবার খাওয়ার নিমন্ত্রণ।
কখন আসতে বলেছে?
রাত আটটায়।
কফি খেতে কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে। খেতে একটু অন্যরকম। তাতে অসুবিধা নেই।
কফি কি কড়া হয়েছে?
একটু হয়েছে। আমি কড়া কফি পছন্দ করি।
এখানে তুমি একটা ভুল করছ। শীতল পানীয় খেতে হয় কড়া। আর উষ্ণ পানীয় খেতে হয় হালকা করে।
আমি কফির মাগো চুমুক দিতে দিতে বললাম, আপনার এখানে আসা আমার জন্যে শিক্ষাসফরের মতো, কত কী যে শিখি।
আরেফিন সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি কি আমাকে রিডিকুল করার চেষ্টা করছি?
জ্বি না।
আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যারা জোকারি করে তারা জোকারির ফাঁকে ফাঁকে অন্যকে রিডিকুল করার চেষ্টাও করে। তুমি কফিটা খাচ্ছ না কেন?
ভালো লাগছে না।
ভালো না–লাগলেও খেতে হবে।
কেন, আপনি বানিয়েছেন বলে?
আরেফিন সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আমি তোমাকে ভয়াবহ কিছু কথা বলব। কথাগুলি শোনার পূর্বশর্ত হচ্ছে— কফি খেয়ে শেষ করা। কফিতে আমি সামান্য রাম মিশিয়ে দিয়েছি। এই রাম তোমার নার্ভকে ষ্টেবল রাখতে সাহায্য করবে। আমি যে–কথাগুলি বলব তা শোনার জন্যে নাৰ্ভ স্টেবল থাকা দরকার। আমি যে পাচ পেগী হুইস্কি খেয়েছি। এই কারণে খেয়েছি।
পাঁচ পেগ হুইস্কি আপনাকে কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না।
আমি খুব শক্ত নার্ভের মানুষ। কতটা শক্ত তা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। যাই হোক কফিটা তাড়াতাড়ি শেষ করো।
কফি খাব না। রাম দেয়া কফি খেয়ে অভ্যাস নেই। আমার গা কেমন যেন করছে। শেষটায় ময়ূরের মতো নাচতে শুরু করলে কেলেঙ্কারি।
Young man dont try to be funny.
খালু সাহেব। আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, বলে ফেলুন। আমার নার্ভ আপনার মতো শক্ত না হলেও খারাপ না। প্লাষ্টিকের নার্ভ। কোনো কিছুতেই এফেক্ট করে না।
তুমি দয়া করে আমাকে খালু সাহেব ডাকবে না। খালু সাহেব শুনতে ভালো লাগে না। আমাকে নাম ধরে ডাকতে পার কোনো সমস্যা নেই। নাম ধরে ডাকতে খারাপ লাগলে আরেফিন সাহেবও বলতে পার।
আপনাকে নাম ধরে ডাকলে মালিহা খালা রাগ করবেন।
আরেফিন সাহেব অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার মালিহা খালা রাগ করবেন না। রাগ করার মতো অবস্থা তার না। তিনি মারা গেছেন। She is deadlike a log.
আমি তাকিয়ে আছি। আরেফিন সাহেব বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খালিগ্লাস নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। গ্লাস ভর্তি করে ফিরে এলেন। গ্লাসে বরফের টুকরো ভাসছে। গোল করে কাটা লেবুর স্নাইস ভাসছে। তিনি চুমুক দিতে দিতে আসছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে যে–জিনিস তিনি খেতে খেতে আসছেন তা অত্যন্ত স্বাদু।
মৃত্যুসংবাদ শুনে চেচিয়ে ওঠেনি। এতে আমি ইমপ্রেসড। মৃত্যু এমন কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। মৃত্যুসংবাদ শুনে হাতপা এলিয়ে পড়ে যাওয়াও কোনো কাজের কথা না। বেশিরভাগ মানুষ এরকম করে। যাই হোক এখন আমি পুরো ব্যাপারটা বলব। তুমি মন দিয়ে শোনো।