হিমু!
জ্বি।
ময়ূরের নোচ কখনো দেখেছি?
জ্বি না।
চিড়িয়াখানার পোষা ময়ুরের আধুনিক নাচ না, বন্য ময়ুরের নোচ। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। পুরুষ ময়ুররা সঙ্গিনীদের মনোহরণ করার জন্যে নাচে–সে এক দর্শনীয় জিনিস। সেই নাচের তাল আছে, ছন্দ আছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হাই বিটের যে–কোনো মিউজিক ফিট করা যায়। কখনো ছন্দপতন হবে না। তবে নাচের চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার একটা আছে। সেটা হচ্ছে নাচ থামানো। ময়ুর নাচ থামায় হঠাৎ। দ্রুতলয়ের যে–কোনো জিনিস থামার একটা নিয়ম আছে। ময়ুরের বেলায় কোনো নিয়ম নেই। তার নাচ হঠাৎ থেমে যাবে। এবং সে নাচ থামিয়ে মাটির দিক তাকিয়ে নিশ্চল হয়ে থাকবে। মনে হবে হঠাৎ কোনো এক গভীর শোকে সে স্তম্ভিত। যেন তার সংসার হঠাৎ ভেঙে গেছে। আর নাচ নয়।
আমি হাই চাপতে চাপতে বললাম, ইন্টারেস্টিং।
আরেফিন সাহেব বললেন, তোমার ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না তোমার কাছে ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। তুমি হাই চাপার চেষ্টা করছি।
তা অবশ্যি করছি। ঘুম পাচ্ছে।
রাত তো মোটে নাটা এখনই ঘুম পাচ্ছে কেন?
বুঝতে পারছি না কেন। আমি আপনার গল্পের মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। অভদ্রতা হবে বলে অনেক কষ্টে জেগে আছি। আপনার ময়ুর বিষয়ক গল্প শেষ হয়েছে তো? না-কি এখনো বাকি আছে? নাচ শেষ করার পর ময়ুর করে কী?
আরেফিন সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, মূল গল্প শেষ হয়েছে। পরিশিষ্ট বাকি আছে। সেটা বলব কি-না বুঝতে পারছি না। যে আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনে না। তাকে গল্প শুনিয়ে কোনো মজা নেই।
আমি বললাম, ঠিক বলেছেন। আমাদের দেশের মানুষরা বক্তৃতা শুনতে খুবই পছন্দ করে বলেই রাজনীতিবিদরা এত বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার মাঝখানে যদি লোকজন চেঁচিয়ে বলত—অফ যা তাহলে বক্তৃতার ডোজ কমত।
তাতে কী লাভ হত? বক্তৃতা কমলেই কি কাজ বেশি হয়?
আমি বললাম, আপনার ময়ুর বিষয়ক গল্পের শেষটা বলে ফেলুন। আমি এখন উঠিব। আপনার এখানে আধঘণ্টা থাকিব ভেবে এসেছিলাম। পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে।
যাবে কোথায়?
কোথায় যাব এখনো ঠিক করিনি।
আরেফিন সাহেব সামান্য বুকে এসে বললেন, তুমি কি আসলেই জান না তুমি কোথায় যাবে? না-কি তুমি জান কিন্তু তোমার চারদিকে রহস্যময়তা তৈরি করার জন্যে এরকম বলো।
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, ঠিক ধরেছেন। আমি আমার চারদিকে ইচ্ছা! করে ধোঁয়া বানিয়ে রাখি। ভেজা খড় পুড়িয়ে বুনকা বুনকা ধোঁয়া–
কন্যার বাপে হুক্কা খায়
বুনকা বুনকা ধোঁয়া যায়।
আরেফিন সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, হড়বড় করে কী বলছ? কন্যার বাপে হুক্কা খায়। বুনকা বুনকা ধোঁয়া যায়। এই ছড়াটা কেন বললে, কোন কনটেক্সটে বললে?
এমনি বললাম। তেমন কিছু ভেবে বলিনি। মাথায় দু-লাইন ছড়া এসেছে বলে ফেলেছি।
মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের পেছনে লজিক থাকবে। কার্যকারণ থাকবে। শুধুমাত্র উন্মাদরাই লজিকের ধার ধারে না। তার মনে যা আসে সে তাই বলে। তুমি নিশ্চয়ই উন্মাদ নও। আমাকে বলো। এক্সপ্লেইন ইট টু মি। ময়ুরের নাচের সঙ্গে কন্যার বাপের হুক্কা খাবার কী সম্পর্ক?
আমি আরেফিন সাহেবের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোককে উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তিনি যেন হঠাৎ আমার ওপর রেগে গেছেন। এই রাগ তিনি লুকিয়েও রাখছেন না। প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তাঁর মতো সফিসটিকেটেড মানুষরা রাগলেও রাগ প্ৰকাশ করেন না। পাতলা ফিনফিনে রেশমি রুমালে তাদের মুখ ঢাকা থাকে। সেইসব রুমাল ফিল্টারের মতো কাজ করে। মুখের রাগ, বিরক্তি তারা ফিল্টার করে রেখে দেয়।
রাগলে মানুষের মুখ ছোট হয়ে যায়। আরেফিন সাহেবের মুখ এমনিতেই ছোট, এখন আরো এক সাইজ ছোট হয়েছে। তাঁর চোখ আগেও জ্বলজ্বল করছিল, এখন একটু বেশি জুলছে। এটা মদ্যপানের জন্যেও হতে পারে। আমি এসে দেখি তিনি ক্রিস্টালের গ্লাসে হুইস্কি খাচ্ছেন। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তিন গ্লাস হয়েছে। প্রচুর মদ্যপান করলে মানুষের চোখ চকচক করে। এই জ্ঞানও আমার আরেফিন সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া। এলকোহল বেশি পরিমাণে শরীরে ঢুকলে চোখের মণি ডাইলেটেড হয়। তখন আলো বেশি প্রতিফলিত হয়।
হিমু।
জ্বি।
ময়ূরের গল্পের শেষটা বলে ফেলি।
জ্বি বলুন। আমার ঘুমাও কেটে গেছে। এখন আর গল্প শুনতে শুনতে হাই তুলব না।
হাই তুললেও ক্ষতি নেই। যারা শিক্ষকতা করে তারা শ্রোতাদের হাই তোলায় বা কথার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়ায় আহত হয় না। এর সঙ্গে তারা পরিচিত। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাসে কম করে হলেও পাচটা ছেলে হাই তুলবে। দুজন ঘুমিয়ে পড়বে। এবং চারজন পাশের বন্ধুর সঙ্গে কাটাকুটি ধরনের খেলা খেলবে।
আমি ময়ূরের গল্পের শেষ অংশ শোনার জন্যে তৈরি হলাম। ভালো ছাত্ৰ ভালো ছাত্ৰ ভাব করে আরেফিন সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। যেন এটা মানুষের মুখ না— ব্ল্যাকবোর্ড। ব্ল্যাকবোর্ডে চকের লেখা আপনাআপনি ফুটে উঠছে। আমার হাতে নোটবই। নোটবই–এ আমি নোট করছি।
প্রায় একঘণ্টা হাতে ধরে— জ্ঞানী অধ্যাপকের বকবকানি শুনছি— মানুষের পক্ষে যতটুক বিরক্ত হওয়া সম্ভব তারচেয়েও বেশি বিরক্ত হয়েছি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এর মধ্যে একবারের জন্যেও মালিহা খালা উঁকি দেননি।
আমি কাঁটায় কাটায় রাত আটটায় এসেছি। এরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই দীর্ঘদিন দেশের বাইরে কাটিয়েছেন। সময়ের ব্যাপারে। এরা খুবই সাবধান। কেউ এলে প্রথম তার দিকে তাকান না, প্রথম তাকান ঘড়ির দিকে। আমি আসার পর থেকে ময়ুর–বিষয়ক জ্ঞানের কথা শুনছি। মালিহা খালার দেখা নেই। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে উনি বোধহয় বাসাতেই নেই। বাসায় থাকলে এর মধ্যে কোনো-না-কোনো স্পেশাল ডিশ নিয়ে উপস্থিত হতেন। খাঁটি বাংলা ধরনের খাবার— যে খাবার রান্না করতে বাঙালি মেয়েরা ভুলে গেছেন, কুমড়ো ফুলের বড়া, খাসির নাড়িভুড়ি ভাজা, গরুর চর্বিতে ফ্রাই করা কটকটি ভাজা। কিন্তু মালিহা খালা ভোলেননি।