ফ্যানের হুক ঠিকমত লাগানো আছে কি-না দেখে নেবেন। বোকের মাথায় ঝুলে পড়লেন তারপর ফ্যান নিয়ে ধপাস করে পড়ে কোমর ভেঙ্গে ফেললেন। এটা ঠিক হবে না।
রসিকতা করছি?
জ্বি।
আমার একটা প্রবলেম আছে হিমু। কেউ আমার সঙ্গে রসিকতা করলে আমার ভাল লাগে না।
ও।
ও না, কথাটা মনে রেখো।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি ঘুমুতে যাও।
আপনি ঘুমুবেন না?
উঁহু। বই পড়ব। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি কিছুক্ষণ বই পড়ি। ফিলসফির বই। এটা আমার অনেক দিনের বদ অভ্যাস।
আমি না ঘুমানো পর্যন্ত আপনি তা হলে বই পড়তে পারছেন না?
না।
তা হলে এক কাজ করি। আমি চলে যাই–কারণ আমার ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
এত রাতে যেতে পারবে?
আমি তো ঘোরাফেরা রাতেই করি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। খালু সাহেব। আপত্তি করলেন না। দরজা খুলে দিলেন। ফিলসফির বই পড়াটা মনে হচ্ছে তাঁর জন্যে খুবই জরুরি।
পাখিরা উড়ে বেড়ায়
পাখির সঙ্গে কি মোবাইল টেলিফোনের কোনো মিল আছে? পাখিরা উড়ে বেড়ায়। মোবাইল টেলিফোনও এক জায়গায় স্থির থাকে না–মানুষের হাতে কিংবা পকেটে ঘুরে বেড়ায়। পাখিরা কিচকিচ শব্দ করে মানুষের ঘুম ভাঙায়। মোবাইল ফোনও তাই করে। এই মুহুর্তে আমার ঘুম ভেঙেছে মোবাইল টেলিফোনের শব্দে। আমি টেলিফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে অসম্ভব মিষ্টি গলা শোনা গেল–
আপনি কি হিমালয়? বলুন দেখি আমি কে?
বলতে পারছি না। এমন মিষ্টি গলা এর আগে শুনিনি।
আচ্ছা আপনাকে তিনটা প্রশ্ন করার সুযোগ দিচ্ছি। তিনটা প্রশ্ন করে যদি জেনে নিতে পারেন। আমি কে তা হলে তো জানলেনই। আর না পারলে আমি কে সেই পরিচয় দেব না। কিছুক্ষণ গল্প করব। ও ভাল কথা তিনটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারবেন, কিন্তু নাম জানতে চাইলে পারবেন না। এখন বলুন আপনার প্রথম প্রশ্ন।
আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমাদের ওখানে কি এখন লোডশেডিং চলছে? না ইলেকট্রিসিটি আছে।
ইলেকট্রসিটি আছে।
এখন বাজে ক’টা?
সকাল নটা কুড়ি। আপনার তিনটা প্রশ্ন কিন্তু করা হয়ে গেছে। আপনি কি বুঝতে পেরেছেন। আমি কে?
তুমি হচ্ছ জুঁই।
আপনি যে প্রশ্নগুলি করেছেন সেখান থেকে আমি যে জুঁই এটা কিন্তু বোঝার কথা না।
তুমি কথা বলছিলে আর আমি তোমার গলার স্বর মনে করার চেষ্টা করছিলাম।
আপনার টেলিফোন নাম্বার কার কাছ থেকে পেয়েছি জানতে চাইলেন না?
না। কারণ আমি অনুমান করতে পারছি। তোমার বাবাকে একদিন টেলিফোন করেছিলাম। সেখান থেকে …।
থাক, আর বলতে হবে না। বাবাকে আপনি চেনেন কীভাবে?
এই প্রশ্ন তুমি তোমার বাবাকে করো না কেন? উনিই জবাবটা ভাল দেবেন।
বাবাকে করেছিলাম। বাবা বললেন, আপনি পুলিশের ইনফরমার। মাঝে মধ্যে পুলিশকে গোপন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন।
ও আচ্ছা।
আপনি পুলিশের ইনফরমার শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে।
খারাপ লাগার কী আছে। ধরো একটা খুন হয়েছে–আমি খুনী ধরার ব্যাপারে পুলিশকে কিছু গোপন তথ্য দিয়ে সাহায্য করলাম। আমি যা করলাম তা হল সামাজিক দায়িত্ব পালন করা।
পুলিশের ইনফরমাররা এই জাতীয় দায়িত্ব পালন করবার জন্যে টাকা নেয়। টাকার বিনিময়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন ব্যাপারটা হাস্যকর না!
হ্যাঁ হাস্যকর।
আপনি কি পুলিশের ইনফরমার?
এখনো বুঝতে পারছি না।
এখনো বুঝতে পারছি না মানে কী?
মানেটা পরে বলব।
আমি যে আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করি সেটা কি আপনি জানেন?
না জানতাম না। এখন জানলাম।
আমি নিজেও জানতাম না। আমি নিজে কখন জানলাম জানেন?
কখন জানলে?
আপনাকে রেখে আঁলিয়াস ফ্রাসিসে ক্লাস করতে গেলাম। ক্লাস শেষ করে ফিরে এসে দেখি আপনি নেই। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল এবং আমি বুঝলাম যে আপনাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি। …
ঐদিনের ব্যাপারটা হচ্ছে…
ঐদিনের ব্যাপারটা আমি জানতে চাচ্ছি না। আজ রাত আটটার দিকে কি আপনি আমাদের বাড়িতে আসতে পারবেন?
কেন বলো তো?
ডিনারের নিমন্ত্রণ।
আজ আমার একটু সমস্যা আছে। আজ আমার মালিহা খালার বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ। খালা অতি জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। আচ্ছ এক কাজ করা যেতে পারে, ডিনার শেষ করে তোমাদের বাড়িতে যেতে পারি। দশটার দিকে যদি আসি। রাত দশটা কি খুব বেশি রাত?
জুঁই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। মেয়েটা ভয়াবহ রাগ করেছে। এই রাগ ভাঙানোর একমাত্র উপায় রাত দশটায়। ওদের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া। খালি হাতে না, দুটা বেলীফুলের মালা থাকতে হবে। বাংলাদেশের কোনো মেয়ে বেলীফুলের মালা হাতে নিয়ে রেগে থাকতে পারে না। এই ফুলের গন্ধের ভেতর কিছু আছে–ঝপ করে রাগ কমিয়ে দেয়।
আমি বসে আছি আরেফিন সাহেবের সামনে। ভদ্রলোককে আজ অনেক হাসি খুশি লাগছে। সোফায় পা উঠিয়ে বসেছেন। সফিসটিকেটেড মানুষরা কখনো পা নাচায় না। তিনি পা নাচাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী?
হিমু।
জ্বি।
তুমি কেন আছ বলো তো?
বুঝতে পারছি না কেমন আছি।
আরেফিন সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তোমার জবাবটা আমার পছন্দ হয়েছে। হোমোসেপিয়ানসরা বেশিরভাগ সময়ই বুঝতে পারে না তারা কেমন আছে। তাদের নার্ভ সবসময় উত্তেজিত থাকে। উত্তেজিত নার্ভ ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ঠিকমতো আনা–নেয়া করতে পারে না।
আমি কিছু না–বুঝেই হ্যাঁ–সূচক মাথা নাড়লাম। আরেফিন সাহেব আগের জায়গায় ফিরে গেলেন–বেতের সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। তিনি বসেছেন। পা তুলে। দুই হাঁটুর মাঝখানে তাঁর ছোটখাটো মাথাটা দেখা যাচ্ছে। তাঁর মুখ হাসি–হাসি। কালো ফ্রেমের চশমার ভেতরের চোখ দুটিও হাসি–হাসি। আসল হাসি না, নকল হাসি। মানুষের চোেখও যে নকল হাসি হাসতে পারে তা এই ভদ্রলোককে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।