মমীর মত আষ্টে পৃষ্ঠে কাপড় দিয়ে মুড়ানো?
হুঁ। এই ভাবে ডীপ ফ্রীজে রেখে দিবি আধা ঘন্টা।
লে হালুয়া। এই মুরগী কি ঠাণ্ডায় রান্না হবে?
মোটেই ঠাণ্ডায় রান্না হবে না। ডীপ ফ্রীজে রাখা হয়েছে পেস্টটাকে জমাট বাধানোর জন্যে।
ও আচ্ছা ৷
আধাঘন্টা পর ডীপ ফ্ৰীজ থেকে মুরগীটা তুলে ডুবন্ত ঘিতে ভেজে ফেলবি।
কাপড় শুদ্ধ?
অবশ্যই কাপড় শুদ্ধ।
খাব কী ভাবে? কাপড়ও খাব?
খাবার সময় কাপড় খুলে নিয়ে খাবি।
এই জিনিসই কি আজ হচ্ছে?
হ্যাঁ এই জিনিসই হচ্ছে। তুই চোখ এমন কপালে তুলে ফেললি কেন? মুরগী তো আর তোকে রান্না করতে হচ্ছে না। আমি রান্না করব।
রান্নার সময় তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তোমার পাশে থাকতে বলবে না?
না বলব না। তুই বরং টিভি দেখিস। এর মধ্যে তোর খালু সাহেব চলে আসবে। তার সঙ্গে গল্প করবি।
কলিংবেল বেজে উঠল। মালু খালা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, দরজা খুলে দে তো হাদি এসেছে।
আমি বললাম, বুঝলে কী করে হাদি। খালু সাহেবও তো হতে পারেন।
খালা বললেন, ভক ভক করে রসুনের গন্ধ আসছে। সেখান থেকে বুঝেছি। হাদির গা থেকে রসুনের গন্ধ আসে। তুই রাসুনের গন্ধ পাচ্ছিস না?
না।
আমি পাচ্ছি। ভকভক করে গন্ধ আসছে। বুঝলি হিমু আমার সিক্সথ সেন্স বলছে আমার মৃত্যু হবে হাদি ব্যাটার হাতে। কেমন কেমন করে যেন আমার দিকে তাকায়।
তোমাকে সে খুনটা করবে। কেন? মোটিভ কী?
এখানের সবকিছু দেখাশোনা করে সে। সে কিছু একটা গণ্ডগোল করে রেখেছে। আমাকে মেরে ফেললে গণ্ডগোলটা চোখে পড়বে না। As simple as that.
আমি দরজা খুললাম। খালু সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। নিউ অর্লিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক আরেফিন সাহেব। ভদ্রলোক শুধু যে জ্ঞানী তা না, তার চেহারাও জ্ঞানী জ্ঞানী। তাকে দেখলেই মনে হয় জ্ঞানের ঝকঝকে নতুন ডিকশনারী। তার চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি। বাইরে থেকে ঘুরে এসেছেন। অথচ তার পাঞ্জাবির ইস্ত্রী এতটুকু নষ্ট হয়নি।
কেমন আছেন খালু সাহেব।
ভাল আছি হিমু সাহেব। দেশে ফিরে তোমাকে না পেয়ে তোমার খালার প্রায় মাথা খারাপ হবার মত জোগাড় হয়েছিল। এখন আশাকরি তার মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে।
বলতে বলতে খালু সাহেব হাসলেন। সেই হাসিও দেখার মত জ্ঞান ঝরে ঝরে পড়ছে।
হিমু!
জি।
এসো বসো আমার সঙ্গে। গল্প করি। খালা বললেন, গল্প পরে করবে। আমি এখন রান্না করছি ও আমার পাশে থেকে রান্না দেখবে।
আরেফিন খালু হাসিমুখে বললেন— আচ্ছা ঠিক আছে। দেখুক। বুঝলে হিমু রান্না হচ্ছে মেয়েদের কাছে একটি শিল্প কৰ্ম–a creative work, কোনো সৃষ্টিশীল কাজ যখন কেউ করে তখন কাউকে না কাউকে পাশে লাগে যে সেই কাজ এপ্রিশিয়েট করবে। কাজেই তুমি তোমার খালার পাশে থাক। মাঝে মধ্যে আমার কাছে কিছুক্ষণের জন্যে বসতে পাের। রান্না বিষয়ক কিছু মজার তথ্য আমার কাছে আছে। হয়তোবা তোমার ভাল লাগবে।
আমি আমার সময়টা তিন ভাগে ভাগ করলাম। কিছুক্ষণ খালার সঙ্গে থাকি। তার রান্না দেখি। কিছুক্ষণ হাদি সাহেবের সঙ্গে থাকি। হাদি সাহেব মিস্ত্রী নিয়ে চলে এসেছেন, তারা দুজন ফ্যান নামাচ্ছেন। এদের কাজ কর্ম দেখি। তারপর যাই আরেফিন সাহেবের কাছে। মুগ্ধ হয়ে আরেফিন সাহেবের গল্প শুনি–বুঝলে হিমু। রান্না মাত্র তিন রকম,
পোড়া
ভাজা
সিদ্ধ
পৃথিবীর যাবতীয় রান্না এই তিনের পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন। রান্নার সবচে আদি রেসিপি বইটা কোথায় পাওয়া গেছে জান?
জ্বি না। মিশরের পিরামিডের ভেতর। সমাধিকক্ষে। ফারাওদের খাবারের রেসিপি।
সেই রেসিপি কি আছে। আপনার কাছে?
হ্যাঁ আছে। তোমার খালাকে বলেওছিলাম রেসিপি দেখে রান্না করতে। মিশরের ফারাওদের খাবার খেয়ে দেখি। সে রাজি হয়নি।
রাজি হননি কেন?
রেসিপিটা হল ময়ুর রান্নার। পাখা শুদ্ধ আস্ত ময়ুর রান্না করা হয়। সেই ময়ুর খাবার টেবিলে এমন ভাবে সাজানো হয় যেন মনে হয় জীবন্ত ময়ুর বসে আছে। এক্ষুনি উড়ে চলে যাবে। ভাল কথা হিমু বাংলাদেশে কি ময়ুর পাওয়া যায়?
চিড়িয়াখানায় পাওয়া যায়। তবে তারা রান্না করে খাবার জন্যে ময়ুর দেবে বলে মনে হয় না। আপনি বললে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
না থাক। ফারাওদের মত ময়ুর খাবার একটা সখ অবশ্যি মাঝে মধ্যে হয়।
খাওয়া-দাওয়া সারিতে সারিতে রাত একটা বেজে গেল। আরেফিন খালু বললেন, এত রাতে মেসে ফিরে কী করবে থেকে যাও। পরিচিত বিছানা ছাড়া ঘুম হয় না। আশা করি এ ধরনের কোনো ব্যাপার তোমার মধ্যে নেই। অবশ্যি গরমে কষ্ট হবে। ফ্যান খুলে নিয়ে গেছে।
আমি থেকে গেলাম। আরেফিন খালু গল্প করছেন। আমি শুনছি। খালুর কাছে জানা গেল মালু খালা রাতে ভেতর থেকে শক্ত করে দরজা বন্ধ করে একা ঘুমান। দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকে তিনি রাতে খালু সাহেবকে এক বিছানায় নিয়ে ঘুমুতে পারেন না।
হিমু!
জ্বি খালু সাহেব।
আমি যে মোটামুটি একটা ভয়াবহ অবস্থায় আছি তা-কি বুঝতে পারছি?
পারছি।
দেখ তো আমার গা দিয়ে রসুনের গন্ধ আসছে কি-না।
না-তো।
তোমার খালার ধারণা সন্ধ্যার পর থেকে আমার গা দিয়ে রসুনের গন্ধ বের হয়। সহজ স্বাভাবিক ভাবে যে মানুষটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ভেতর যে কী পরিমাণ অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে— তোমার খালা হচ্ছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সন্ধ্যার পর থেকে আমি মদ খেতে বসি। রাত দুটা তিনটা পর্যন্ত খেয়েই যাই। তোমার খালার অসুখ যদি খুব শিগগির না। সারে তা হলে আমি পুরোপুরি এলকোহলিক হয়ে যাব। এক দিন দেখা যাবে নিজেই গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়েছি।