মালু খালা দরজা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে চিনতে পারছেন না। চিনতে না পারার কোনোই কারণ নেই। আমার চেহারা আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। পোশাক আশাকেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি বললাম, কেমন আছ খালা?
খালা তাকিয়ে রইলেন জবাব দিলেন না।
চিনতে পারছি তো?
পারছি। বুক ধড়ফড় করছে। বুক ধড়ফড়ানিটা কামুক তারপর কথা दक्लि।
দরজা থেকে সরে দাড়াও ভেতরে ঢুকি। না-কি তুমি চাও না আমি ঢুকি?
খালা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। আমি ঘরে ঢুকে সোফায় বসলাম। পানির বোতল এবং গ্লাস হাতে আমার পাশে বসতে বসতে বললেন
বেলটা শুনেই বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে। তোর খালু বাসায় নেই। একা তো এই জন্যে।
তোমার কী মনে হচ্ছিল? সবুজ রঙের ইলেকট্রিকের তার নিয়ে কেউ তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে? তুমি দরজা খুলবে। আর সে তার গলায় পেঁচিয়ে তোমাকে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেবে?
খালা ঢক ঢক করে পানি খেতে খেতে বললেন–আসলেই তাই ভেবেছি। পুরোপুরি প্যারানয়েড হয়ে গেছি। হাদিকে পাঠিয়েছি ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আনতে। সেই সকালে পাঠিয়েছি। এখনো আসছে না।
ইলেকট্রিক মিস্ত্রী কী করবে?
সিলিং ফ্যান সবগুলো খুলে ফেলবে। আমি এ বাড়িতে কোনো সিলিং ফ্যান রাখব না।
সিলিং ফ্যান খুলে লাভটা কী?
স্বপ্নে দেখি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই জন্যেই ফ্যান খুলব।
ফ্যান খুললেও লাভ হবে না। ফ্যানের হুক তো থাকবে। তোমাকে হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেবে।
খালা বিরক্ত মুখে বললেন, তুই এই ভাবে কথা বলছিস যেন আমাকে সত্যি সত্যিই ঝুলাবে।
আমি বললাম, তুমিও এমন ভাব করছি যে সত্যি সত্যি তোমাকে ঝুলানো হচ্ছে।
আমি বলেছি বলে তুইও বলবি। আমার না হয় মাথার ঠিক নেই। তোর তো মাথা ঠিক আছে।
আমার ব্যাপারটা খালা অন্য রকম। আমি যখন যার কাছে থাকি তখন তার মত হয়ে যাই। মাথা খারাপের সঙ্গে থাকলে আমারও মাথা খারাপ থাকে, সুস্থ মাথার মানুষের পাশে আমার মাথাও সুস্থ থাকে। দুষ্ট লোকের কাছে যখন থাকি তখন আমিও দুষ্ট হয়ে যাই। আবার যখন……….
চুপ কর তো।
আচ্ছা চুপ করলাম। খালা সোফা থেকে উঠতে উঠতে বললেন, তোকে দিয়ে আমি একুশটা কাজ করাব। আমি বললাম, চিঠিতে লিখেছিলে আঠারোটা।
তিনটা বেড়েছে। প্রথম যে কাজটা তুই আমার জন্যে করবি সেটা হচ্ছে–আমার জন্যে একজন কেয়ার টেকার জোগাড় করবি।
হাদি সাহেব বিদায়?
অবশ্যই বিদায়। ওকে দেখলেই আমার গা শিরশির করে। তারচে বড় কথা লোকটার গা থেকে রসুনের গন্ধ বের হয়।
ও।
শুধু ও বললে হবে না। আমি স্বপ্নে যে লোকটাকে দেখি ওর গা থেকেও রসুনের গন্ধ আসত।
তা হলে তো বিদেয় করতেই হয়।
তুই ভাল রেফারেন্সের একটা লোক বের করবি। আমি প্রতি মাসে চার হাজার টাকা দেই। চার হাজার টাকা খেলা কথা না।
তোমার বুক ধড়ফড়ানি কি একটু কমেছে?
হুঁ কমেছে। দিনের বেলা এমিতেই কম থাকে। সন্ধ্যার পর বাড়ে।
খালু সাহেব কোথায়? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তার কী সব পুরানো বন্ধু বান্ধব আছে তাদের কাছে গিয়েছে। চলে আসবে। তুই দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবি।
কী খাওয়াবে?
যা খেতে চাস খাবি। তোকে দেখে কেন জানি খুব মায়া লাগছে। দেখি কাছে আয় গায়ে হাত বুলিয়ে দেই।
আগে আমার জন্যে চা নিয়ে এসো। চা খেতে থাকি সেই ফাকে গায়ে হাত বুলাও।
আমার মধ্যে কোন চেঞ্জ দেখতে পাচ্ছিস? পাচ্ছি। তুমি আগের চেয়ে মোটা হয়েছ। অনেক খানি ফুলেছ। খালা আহত গলায় বললেন, আমার ওজন কমেছে নয়। পাউন্ড। আমি স্পেশাল ডায়াটে আছি। আর তুই বলছিস মোটা হয়েছি? তুই কি ইচ্ছা করেই উল্টো কথা বলিস?
চা খাব খালা।
গরমের মধ্যে চা খাবি? টকা দৈ দিয়ে লাচ্ছি বানিয়ে দেই। দৈ ঘরে পেতেছি। দৈ বানানোর একটা যন্ত্র এবার নিয়ে এসেছি। এত সুন্দর দৈ হয় বলার না। আমি আমেরিকায় ফিরে যাবার সময় তোকে দিয়ে যাব।
আমি ঐ যন্ত্র দিয়ে কী করব?
দৈ বানাবি। এরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে দেখে মনে হচ্ছে দৈ বানানো ভয়ংকর কোনো কাজ। বোমা বানানোর মত।
অনেকটা সে রকমই। খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুতি প্ৰযুক্তির পেছনে সময় নষ্ট করা আমার জন্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সে ইচ্ছা করলে ভিক্ষা করে খাবে। কিন্তু হাড়ি পাতিল নিয়ে রান্না করতে বসবে না।
ফজিলামি ধরনের কথা বলবি না তো হিমু। আমার অসহ্য লাগে। আয় দৈ কী করে বানাতে হয় দেখে শিখে রাখ। দুপুরে হালকা ধরনের কিছু করব। ভাত টেংরা মাছ টাইপ। রাতে কিছু স্পেশাল ডিশ। রাজস্থানের এক মহিলার কাছ থেকে চিকেনের একটা প্রিপারেশন শিখেছি। অপূর্ব। গ্ৰীন চিকেন। লাউ পাতা বেটে সবুজ রঙের একটা পেষ্ট করা হয়। সেই পেদ্ষ্টে ভিনিগার মিশিয়ে আস্ত মুরগী মাখিয়ে স্টীম করা হয়। মুরগী স্টীম হতে থাকবে এই ফাঁকে আরেকটা পেষ্ট বানাতে হবে। পোস্তা বাটা এবং বাদাম বাটার পেস্ট।
রান্না বান্নার এইসব কথা শুনতে একটুও ভাল লাগছে না।
তোর খালুর জ্ঞানের কথার চেয়ে রান্না বান্নার কথা শেখা অনেক ভাল। চুপ করে শোন। পোস্তা বাটা এবং বাদাম বাটার পেষ্টের সঙ্গে মিশাবি পেয়াজের রস। তারপর স্টীম মুরগীটার গায়ে এই পেষ্ট মাখাবি। বেসন যে ভবে মাখায় সেই ভাবে।
হুঁ তারপর।
এখন শুনতে মজা লাগছে না?
খুবই মজা লাগছে। তারপর বলো—
খুব পাতলা কাপড় দিয়ে মুরগীটাকে জড়াবি। সুতা দিয়ে পেঁচাবি যেন কাপড় সরে না যায়।