কিষান যথারীতি মদের বোতল আর টেলিভিশন খুলে বসে যায়, নীলা ঠিক বোঝে, বাজার করা হয়েছে, রান্নার বইও কেনা হয়েছে, এখন তার কাজ রান্নাঘরে ঢুকে রাতের খাবারের আয়োজন করা। নীলা তাই শুরু করে, আঁচলখানা কোমরে গুঁজে। কিষান গলা উঁচু করে বলে, অনেকদিন মালাইকোফতা খাই না, আজ করো তো দেখি কেমন হয়।
আর কী?
নান করো। আর একটা সবজির কিছু থাকলে ভাল হয়, পালক পনির করো।
ও তো বাঙালির খাবার নয়। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, চোখে পেঁয়াজের ঝাঁজ, হাতে রসুনের গন্ধ, নীলা বলে।
আমি তো বাঙালি নই। কিষান হেসে বলে।
ও তাই তো। চোখ ঢেকে দেওয়া উড়ো চুল হাতের পিঠে সরিয়ে নীলাও হাসে।
.
সারা সন্ধে রান্না করে নীলা। টেবিল সাজিয়ে দিয়ে খেতে ডাকে কিষানকে। খেতে খেতে কিষান জিজ্ঞেস করে, রেস্তোরাঁয় ছেলেগুলো অমন ছেঁকে ধরেছিল কেন তোমাকে?
নীলা হেসে বলে, বাঙালি তো, তাই!
মোজাম্মেলের সঙ্গে কী এত গল্প করলে?
কিষানের থালায় মালাইকোফতা তুলে দিয়ে নীলা বলে, কী করে এল এ দেশে, কেমন আছে এসব।
আর কী বলল?
এসবই, বলল কাগজ না হলে ভাল চাকরি জুটবে না।
আর?
আর বলল বেলভিলে থাকে।
আর?
আর বলল সাতজন ছেলে একটি ছোট্ট ঘরে থাকে।
আর?
আর বলল দেশের লোকেরা তাকে ডিসি বলে জানে।
আর?
আর বলল দেশে গেলে চাকরি পাবে না ভাল, বয়স হয়ে গেছে।
আর?
আর বলল বাচ্চু ছেলেটা ডাক্তার।
আর?
আর বলল চায়ে আরেক চামচ চিনি লাগবে কি না। না বলেছি, হ্যাঁ বললে আরেক চামচ চিনি ও এনে দিত। আরও বলল যে চায়ে চিনির বদলে নুন হলে অন্যরকম স্বাদ হয়। আমি বললাম হ্যাঁ তা হয়। ও বলল, দেব এক চিমটি নুন? আমি বললাম, না, তেতো জিনিস আমি একদম পছন্দ করি না। ও বলল, দিই একটা লেবুর টুকরো। আমি বললাম, না টক চা আমি খাই না। আরও বললাম, লেবু বেশি টিপলে কী হয় জানেন তো? ও জিজ্ঞেস করল, কী হয়? আমি বললাম, তেতো হয়।
আচ্ছা তুমি ডাল মাখানি বানাতে জানো? কিষান জিজ্ঞেস করে।
নীলা উত্তর দেয়, না।
তবে যাই বলল, আজকের রান্নাটা সেদিনের চেয়ে ভাল হয়েছে। বইটা তোমার কাজে দেবে।
নীলা খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়ে, তুমি তো মাছ মাংস একেবারেও খাও না। খাবে না?
সে তো তুমি জানোই যে আমি খাই না। এবং কী জানো, কখনও খাব না।
মাছ মাংস খাওয়া অভ্যেস আমার। সবসময় নিরামিষ খেতে পারি না।
আমি যে নিরামিষাশী তা জেনেই তো তুমি বিয়েতে মত দিয়েছ, দাওনি?
হ্যাঁ দিয়েছি। কিন্তু আমি তো বলিনি, আমি আমিষ খাওয়া বন্ধ করব।
এক বাড়িতে দুরকম রান্না হবে, এ তুমি ভেবেছিলে?
অত ভাবার সময় পাইনি।
নীলা এঁটো বাসন রান্নাঘরে ধুতে নিয়ে যায়। কিষান বড় একটি ঢেকুর ছেড়ে ফোলা পেটখানায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, এত ভাল খেলে ভুঁড়ি বাড়বে না তো কি!
নীলা রান্নাঘর থেকে জল পড়ার শব্দকে আড়াল করে উঁচু স্বরে বলে, তুমি তো ডিম খাও দুধ খাও, এ সব তো আমিষ। তবে মাছ মাংস না খাবার কারণটা কী? অভ্যেস নেই, নাকি ভাবো যে জীব হত্যা মহা পাপ!
কিষান কোনও উত্তর দেয় না।
নীলা বলে, আমি না হয় তোমার রেস্তোরাঁয় গিয়ে মাঝে মাঝে খেয়ে আসব। মোজাম্মেলও বলছিল।
কিষান এরও কোনও উত্তর দেয় না।
.
রাতে ঘুমোবার আগে আর দিনের মতো মহা উদ্দীপনায় কিষান যখন শাড়ি খুলতে নেয়, নীলা অপ্রসন্ন স্বরে বলে আমার ঘুম পাচ্ছে।
ঠিক আছে ঘুমিয়ে যাও। আমি আমার কাজ করছি। একটুও টের পাবে না কী করছি আমি।
নীলা জানে এ কাজটি কিষানেরই। এ কাজে তার নিজের কোনও ভূমিকা নেই।
কিষান যখন হাতের তেলোয় স্তন দলছে, নীলা পাশ ফিরে বলে, ঘুমোতে দাও।
নীলাকে ঘুমোতে দিতে কিষানের কোনও আপত্তি নেই, তবে হাত পা মুখ মাথা যেন নীলা না নাড়ে, তা হলেই কিষান তার কাজ ভালয় ভালয় সারতে পারবে। নীলার সংশয় জাগে ভোগের জন্য জীবিত নারীদেহের আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কি না কিষানের। নিস্পন্দ পড়ে থাকে সে, কিষানের ভারী শরীরটি তার শরীরের ওপর কী কাজ করে যায়, কিষান ঠিকই বলেছে একটুও টের পাবে না নীলা, টের নীলা পায় না।
এর পরের ঘটনা নীলা বেশ ভাল জানে, তার শরীর থেকে নেমেই কিষান নাক ডেকে ঘুমোতে থাকবে আর সে অনেকক্ষণ একা একা জেগে থাকবে, ঘুম আসবে না সহজে। সকালবেলা ঘুমের নীলাকে ঠেলে জাগাবে কিষান ওঠো ওঠো ওঠো ওঠো বেলা অনেক। তার অত সকালে জাগতে ভাল লাগবে না, তবুও সে উঠবে, কিষানের খাবার তৈরি করবে, রুটি মাখন সাজিয়ে রাখবে টেবিলে, গেলাসে কমলার রস ঢেলে দেবে। আর নিজের জন্য চা করবে, যখন চা পান করতে থাকবে, কিষান বলবে, চা খেলে গায়ের রং কালো হয়ে যায়।
নীলা জিজ্ঞেস করবে, কখন ফিরবে?
কিষান বলবে ঠিক নেই।
এরপর নীলা জানালায় দাঁড়াবে। জানালা থেকে মানুষ দেখবে রাস্তায়।
.
০৩.
এক শুক্রবার সুনীলের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেল কিষানলাল, নীলাকে নিয়ে। সুনীলের বাড়ি রু দ্য রিভলিতে, ইতালির রিভলিগ্রামের নামে নাম, যেখানে ১৭৯৭ সালে অস্ট্রিয়ানদের পরাজিত করেছিলেন নেপোলিয়ন। চেকস্লোভাকিয়ার অস্তারলিৎস শহরের নামে এ শহরে একটি ইশটিশন আছে, রাস্তা আছে, সেতু আছে, কারণ অস্তারলিৎসে ১৮০৫ সালে নেপোলিয়ন রাশান ও অস্ট্রিয়ান সৈন্যদের হারিয়েছিলেন। ফ্রিডল্যান্ড বলেও রাস্তার নাম আছে, যেহেতু রাশার ফ্রিডল্যান্ডে ১৮০৭ সালে রাশানদের হারিয়েছিলেন নেপোলিয়ন। যে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোয় নেপোলিয়ন জয়ের পতাকা গেড়েছিলেন, সেগুলোই কেবল প্যারিসে সসম্মানে অবস্থিত। প্যারিসের মানচিত্র আঁতিপাতি করে খুঁজেও ওয়াটারলু বলে কোনও জায়গা নীলা পায়নি। বাঁয়ে হোটেল দ্য ভিল, ডানে ল্যুভর জাদুঘর, বাড়ির জানালা থেকে ল্যুভরের কালো ছাদ স্পষ্ট চোখে পড়ে, জানালায় দাঁড়িয়ে সামনে অবাধ সুন্দরের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে নীলা বলে, কিষান তুমি এমন জায়গায় বাড়ি নিতে পারো না?