- বইয়ের নামঃ ফরাসি প্রেমিক
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. দমদম থেকে শার্ল দ্য গোল
ফরাসি প্রেমিক – উপন্যাস – তসলিমা নাসরিন
প্রতিটি মানুষের দুটো মাতৃভূমি, একটি তার নিজের, অন্যটি ফ্রান্স।
–শ্রীবোকাচন্দ্র ঠাকুর
.
দমদম থেকে শার্ল দ্য গোল
মেয়েটি, পরনে লাল বেনারসি, নাকে কানে গলায় হাতে সোনার অলংকার, শুকিয়ে চড়চড় ঠোঁট, উড়োজাহাজ থেকে নেমে ডানে বামে সামনে পেছনে তাকাতে তাকাতে, চলন্ত সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে, রাশি রাশি সাদা মানুষ দেখতে দেখতে হাঁটছে যেদিকে লোক হাঁটছে বেশি, যেদিকে ঢল, কলকল, সেদিকে। ঢল থেমে যায় এক কোণে, একের পেছনে আরেক করে হয়ে যায় দীর্ঘ অজগর। অনেকটা রেশন দোকানে সস্তায় ডাল দিচ্ছে গো, দাঁড়িয়ে যাও-এর মতো। লেজ ডিঙিয়ে, মেয়েটি নিজেকে গলাতে চায় পেটে। পেটের লোকেরা বলে, ও মেয়ে, ও লাল শাড়ি, লেজে যাও, লেজে যাও। মেয়েটি জিভের জলে ঠোঁট ভেজাতে ভেজাতে লেজে ফেরে, সবার পিছে সবার নীচে সবহারাদের মাঝে।
অজগর সড় সড় করে ডিঙিয়ে যাচ্ছে ঝোপঝাড়।
কেবল লেজটিই ঝোপের কাঁটায় আটকে পড়ে।
মেয়েটি, কপালে থেবড়ে যাওয়া সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর, ভেজা ঠোঁট মুখোমুখি হয় দুজনের, কালোর আর সাদার। মেয়েটি কালো পেরিয়ে সাদার দিকে এগোয়, অমাবস্যা পায়ে দলে ধবল জ্যোৎস্নার দিকে। কালো ডাকে, ও মেয়ে, ও লাল শাড়ি, এদিকে। লাল শাড়ি কানে খাটো, হাঁক শুনেছে, ডাক বোঝেনি। সাদার সামনে ত্রিভঙ্গ দাঁড়ায় সুবিনীত সুস্মিতা। দেবী দুর্গার মতো লাগছে না কি, একবার চোখ তোলে। দেবীতে সাদার কিছু যায় আসে না, সাদা চোখ তোলে না, আঙুল তুলে কালোর দিকে ইঙ্গিত করে। লাল শাড়ি কানে খাটো হলেও চোখে খাটো নয়। দু পা বামে গেলেই কালো। বামে যেতে তার পা সরে না, মন সরে না।
কালো তো কালোই, আবার গজদন্ত। মেয়ে ফোঁসে।
পাসপোর্ট। গজদন্তের গভীর গুহা থেকে গমগম শব্দ বেরোয়।
গাঢ় নীল পাসপোর্টটি কালোর চোখের সামনে ধরে মেয়েটি, অজগরের মাথা বুক পেটের লোকেরা যেভাবে ধরে পার পেয়ে গেছে। গজদন্ত খপ করে ধরে গপ করে টোপটি গেলে। শেয়ালের কালো থাবায় ভারতীয় কুমিরের ছানা। যক্ষের ধন পেয়েছে গজদন্ত। টোপটির আগপাশতলা দেখতে দেখতে কালোর লাল টকটক জিভে, মেয়েটি দেখে, জল গড়াচ্ছে।
টিকিট। আবার গুহার গমগম।
এবার আর টোপ নয়। মেয়েটি কালো থাবায় পুরে দেয় দুপাতার টিকিট–দমদম শার্ল দ্য গোল দমদম—বাইশে ফেব্রুয়ারি, একুশে মার্চ নিরানব্বই।
কুমিরছানা চলে গেল মেশিনের তলায়, একবার দুবার তিনবার।
কী করতে এখানে এসেছ হে? গমগম।
সংসার করতে। শুকোতে থাকা ঠোঁট নড়ে।
কোন হোটেলে উঠবে, নাম কী? গমগম।
বাপের হোটেল থেকে স্বামীর হোটেলে উঠবে লাল শাড়ি। এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে জীবন পার।
ঠিকানা কী? গমগম।
টুকরো একটি কাগজ কালো থাবার ভেতর চালান করে, একশো বারো রু দু ফুবো সানদানি, প্যারিস সাত পাঁচ শূন্য এক শূন্য।
টাকা কত আছে? গমগম। দুশো ডলার থাবায় চলে যায়।
আর কত আছে? গমগম।
ঝোলার ভেতরে হাত আনাচ কানাচ খোঁজে, বাসি ফুল, ছেঁড়া চিঠি, দুটো বোতাম আর একটি চিনেবাদামের খোসা, আর আধখাওয়া কমলালেবুর সঙ্গে উঠে আসে বারোশো পঁচিশ টাকা।
গজদন্ত দু আঙুলে শুঁয়োপোকা ভুরু চুলকে চিকন গলায় জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী?
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এগুলো টাকা।
টাকা?
হ্যাঁ টাকা। ভারতের টাকা। মেয়েটির মাস্টারি গলা।
গজদন্ত টাকার এমন চেহারা আগে দেখেনি। সাদা লোকটির চোখ পড়ে টাকায়, নাক কুঁচকে ওঠে, যেন আবর্জনার স্তূপ থেকে এক মুঠো দুর্গন্ধ বিষ্ঠা এনে সামনে রেখেছে কেউ। মেয়েটির পেছনে নতুন অজগর, অজগর লম্বা হচ্ছে, হাঁসফাঁস করছে, বুকের পেটের লোকদের গা জ্বলছে। লাল আপদটি সামনে না থাকলে অনেককাল বেড়া ডিঙিয়ে যেত ওরা। ওদের মত নিজেকেও মেয়েটির বড় এক আপদ বলে মনে হয়।
সাদা তার সাদা চিবুক নেড়ে সাদা আঙুল তুলে বলে, এই লাল শাড়ি, তুমি ওই কোণে গিয়ে দাঁড়াও।
আপদ বিদেয় হয়। কোণে।
নতুন অজগর দ্রুত গড়িয়ে যায়। এই মাথা তো এই লেজ। কারও পাসপোর্ট মেশিনে ঢোকানো হয়নি। কারও ঝোলার ভেতর হাত ঢোকাতে হয়নি, টাকা খুঁজতে হয়নি। কাউকে কোনও কোণে পাঠানো হয়নি। মেয়েটিই একা। মেয়েটিই এক কোণে। কোণটি, মেয়েটির মনে হয়, চিড়িয়াখানার খাঁচা, যারাই পার হচ্ছে, অদৃশ্য খাঁচার ভেতর মেয়েটিকে দেখছে, কালো চোখের কালো চুলের কালচে রঙের আজব জীব দেখছে। মেয়েটি চোখ নামিয়ে রাখে মেঝেয়। অপরাধী চোখ।
অজগরের লেজের শেষ বিন্দুকে ছুটি দিয়ে গজদন্ত যখন সাদার দিকে ঝুঁকে হাসছে, মেয়েটি এক পা দু পা করে কোণের সীমানা ডিঙিয়ে সাদাকে মিনমিনে গলায়, সবাই যে চলে গেল, আমি যাব না? বলতেই সাদা ডানে বামে মাথা দোলায়। মাথা দুলতেই থাকে, এর অর্থ কি না তুমি যাবে না, না কি সাদার মনে কোনও গানের সুর জেগেছে হঠাৎ আর সে সুরে তাল না দিয়ে সে পারছে না।
সাদার মাথা দোলানো দেখে গজদন্ত বেরিয়ে আসে কাচের ঘর থেকে।
হাঁটো। গমগম।
গজদন্ত থামে। কাচের নয়, ইস্পাতের একটি ঘরে, পেছনে লাল শাড়ি। ঘরের ভেতরে দুটো চেয়ারে দুটো নীল পোশাকের সাদা লোক। একটির বেশি বয়স, আরেকটির কম। বেশি বয়সের হাতে যক্ষের ধনগুলো সঁপে দিয়ে গজদন্ত বেরিয়ে যায়। কমবয়সি হাসছিল, মেয়েটিকে দেখে হাসি গিলে ফেলে ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখে প্রসবযন্ত্রণা।