নীলাকে টেনে সোফা থেকে উঠিয়ে, ফ্লুর দ্য ম্যল মেঝেয় ছুড়ে ফেলে, নীলাকে টেনে নেয় বেনোয়া লাইব্রেরি ঘরে, কম্পিউটারের গায়ে জোরে থাপড় মেরে বলে জগৎ এখন কম্পিউটারে চলছে, এত জ্ঞানের বড়াই যখন করছ বলো তো টেন বেস টু টারমিনেটরের সঠিক ভ্যালু কত? জানো না তো! পাঁচশো ওমস। কিবোর্ডে কী আই আর কিউ আছে? নীলা জানে না। বেনোয়া জানে, পাঁচ। বলো, এস সি এস আই বাসে কতগুলো এস সি এস আই নম্বর সম্ভব? আট। ম্যাক এড্রেসে কতগুলো বাইট থাকে বলো। পারবে? জানি পারবে না। তোমার জ্ঞান হল গোল্লা এ সবে। ছটি বাইট থাকে।
শক্ত করে ধরে রেখেছে সে নীলার হাত। টেনে নীলাকে আবার বসার ঘরে এনে সোফায় ছুড়ে দেয়।
নীলা হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, বইটা তুলে দাও।
বেনোয়া ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। বই সে তুলবে না।
বই কে ফেলেছে? আমি না তুমি? নীলা জিজ্ঞেস করে
আমি। বেনোয়া বলে।
তা হলে ভাল ছেলের মতো বইটা তুলে আমার হাতে দাও। তুমি তো দুষ্টু ছেলে নও। দুষ্টু ছেলেদের গড গিভন রাইট আছে বই ফেলে দেবার। তোমার তো নেই। নাকি আছে?
বলে হাসে নীলা।
বেনোয়া চেঁচায় হাসছ কেন?
হাসছি কারণ আমার গড গিভন রাইট আছে হাসার।
নীলা সোফার হাতলে চুল ছড়িয়ে আবার আগের মতো শোয়। আগের মতো সুগন্ধ ছড়িয়ে। বেনোয়া পেছনের সোফায়।
গলা নামিয়ে বলে, নীলা আমার দিকে মুখ করে বসো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে, জরুরি।
নীলা ধীরে, নরম গলায় বলে যায়, আগে বইটি আমাকে তুলে দাও, একটি কবিতা আমার পড়তে ইচ্ছে করছে, পড়াটা জরুরি।
আমার কথা শোনার চেয়ে কবিতা পড়ার গুরুত্ব বেশি? বেনোয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।
নীলা বলে, হ্যাঁ বেশি।
তোমাকেও জাতে ওঠার রোগে ধরেছে। আমাদের দেশে এই হয়, বাইরে থেকে লোক এসে আমাদের শিল্প সাহিত্য নিয়ে আমাদের চেয়েও বেশি মেতে ওঠে হঠাৎ।
জানালার ওপারে রোদেলা বিকেলের দিকে চোখ রেখে বলে, আমি মেতেছি কারণ আমার রক্তে কবিতা।
রক্তে কবিতা! হা হা বেনোয়া অদ্ভুত স্বরে হাসে।
তোমাদের ফ্রান্স যখন বরফের তলে ডুবে ছিল, তখন আমাদের কবিরা কবিতা লিখত। দৃশ্যটি ভাবো, তোমার বর্বর পূর্বপুরুষেরা কামড়াকামড়ি করে কাঁচা মাংস খাচ্ছে, ওদিকে আমার দার্শনিক পূর্বপুরুষেরা কবিতা আওড়াচ্ছে।
বেনোয়ার গায়ে ঝড়ের গতি, বইটি তুলে সে জানালায় ওপারে ছুঁড়ে
থাকো তোমার রক্ত আর গৌরব নিয়ে, পড়ো কবিতা।
ঝড় চলে যায়।
স্নিগ্ধ হেসে শুদ্ধতম নারী মখমল চোখ বোজে। সে চোখে একটি স্বপ্ন এসে বসে, নিজেকে সে দেখে মালাবারের তীরে, হাওয়ায় চুল উড়ছে, শাড়ি উড়ছে, সূর্যাস্তের সবটুকু রং গায়ে মেখে হাসছে সে, দৌড়োচ্ছ খালিপায়ে, জলের সঙ্গে খেলছে লুকোচুরি খেলা, জল ছুঁয়ে দিচ্ছে তার সুতনু শরীর আর হাওয়া তার কানে বলছে
ও মালাবারের মেয়ে,
তোমারই হাতের মতো সুকুমার তোমার পা দুটি,
জঘনে জাগাও ঈর্ষা ব্যক্ত করে শ্বেতাঙ্গীর ত্রুটি,
ভাবুক শিল্পীর চোখে কম্র কান্ত তোমার শরীরে
আরও গাঢ় কালো জ্বলে মখমল চোখের গভীরে।
সেই নীল আতপ্ত হাওয়ার দেশে, যেখানে কবিতা
তোমাকে দিলেন জন্ম—কৌটো ভরে লঙ্কা তেজপাতা
তুলে রাখো, কুঁজোয় ঠাণ্ডা জল, আয়েশি ভর্তার
কলকেতে তামাক সাজো, ঠেকাও মশার হল্লা, আর
যখন ভোরের গান ঝাউবনে ওঠে কেঁপে কেঁপে
কিনে আনো সদ্য বাজার থেকে আনারস, পেঁপে
খোলা পায়ে, যেখানে সেখানে তুমি বেড়াও স্বাধীন
অচেনা পুরনো সুর গুনগুন করে, সারাদিন।
আর লাল সন্ধ্যার আঁচল যেই খসে পড়ে দূরে,
দাও গা এলিয়ে স্নেহে বারান্দায় নরম মাদুরে,
পাখির কুঞ্জনে পূর্ণ তোমার স্বপ্নেরা ভাসমান
এবং পুষ্পল রূপে নিরন্তর তোমারই সমান।
মালাবারের মেয়ে তপ্ত হাওয়ায় ওড়ে, বাড়ির কাছে বইয়ের দোকানে ঢুকে ফ্লর দু ম্যল খোঁজে। বোদেলেয়ার, র্যাবোঁ, পল এলুয়ার, পল ভারলেইন, পল ভালেরি, রেনে শাস কাচের বাক্সে সাজানো। ঝুঁকে বাক্স খুলে বইয়ে হাত বাড়িয়ে নীলা বলে ওরা বাক্সে বন্দি কেন?
কবিতা সপ্তাহ চলছে। দোকানির নিরুত্তাপ কণ্ঠ।
প্রতিটি সপ্তাহই কি কবিতার নয়। প্রতিটি দিনই?
দোকানি হাসে, কবিতার দিন শেষ মাদমোজেল।
নীলার কলকাতায় কবিতার দিন কখনও শেষ হতে দেখেনি। প্রতিটি দিনই কবিতার, প্রতিটি মুহূর্ত কবিতার। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজার লোকের সভা যে সবচেয়ে বেশি মাতায়, সে কবি। মেলায় মাঠে যাকে দেখতে লোকের ভিড় উপচে পড়ে, সে কবি। রাস্তায় বাজারে যে লোকটির পায়ের ধুলো নেয় আবালবৃদ্ধবনিতা, সে কবি। যাকে ফিরে ফিরে লোকে মোহিত চোখে দেখে, সে কবি। প্রতিটি কিশোরই কবিতা লেখে, প্রতিটি কিশোর। প্রেমে পড়লে লেখে, প্রেমে না পড়লেও। বৃষ্টি হলে, বৃষ্টি না হলেও। মাতালের সব মাতলামো ক্ষমা করে দেয় লোকে কলকাতায়, সে যদি কবি হয়। দুষ্টু লোকেরা বলে, কলকাতায় কাকের চেয়ে কবি বেশি, কচুরিপানার মতো ছড়িয়েছে কবি। সুশান্তর প্রেমে পড়ে নীলা নিজেও কবিতা লিখেছে। কবিতা ছাড়া মানুষ বাঁচে কী করে! এই ফরাসি দেশকে কবিতার দেশ বলে জানত সে, এখানে কবিতার বই ছাপাতে আর বিক্রি করতে একটি বিশেষ সপ্তাহের আয়োজন করতে হয়, দাম কমিয়ে রাখতে হয়। নীলা চুক চুক করে দুঃখ করে দেশটির জন্য। বইটি বুকে চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নীলার মনে হতে থাকে, বাড়ির দরজা ভেতর থেকে খুলে দেবেন মলিনা, মাদুর বিছিয়ে তাকে খেতে দেবেন ঝিঙেপোস্ত, সুক্তো, ভাপাইলিশ, তেলকই। পাশে বসে হাতপাখায় বাতাস করবেন আর কপালের ঘামচুল সরিয়ে দিতে দিতে বলবেন, শুকিয়ে একেবারে দড়ি দড়ি হয়ে গেছিস, তৃপ্তি করে খা রে। কদ্দিন খাসনে বল তো মায়ের হাতের রান্না! জিভে জল চলে আসে নীলার। গ্রস্তের মতো বাড়ি ফিরে দরজায় কড়া নাড়ে। কেউ নেই নীলার জন্য অপেক্ষা করে, নিজেকেই দরজা খুলে ফাঁকা ঘরে ঢুকতে হয়। মা মা ডেকে নিজের গলার স্বরে নিজেকে চমকাতে হয়।