কাজি সাহেবের কাছে যাই। ঝামেলা শেষ করে আসি।
মিতু বলল, সব কিছুই আপনার কাছে ঠাট্টা?
আমি বললাম, তুমি যদি আমার মত সবকিছু ঠাট্টা হিসেবে নাও তা হলে দেখবে জীবন ইন্টারেসিটিং।
মিতু বলল, আমি যখন একটা খুন করব তখন ভাবব এটা ঠাট্টা? আবার যখন খুনীর দায়ে ফাঁসিতে ঝুলব সেটাকেও ভাবব ঠাট্টা?
মিতু রাগে কাঁপছে। আমি তার রাগ দেখে মজা পাচ্ছি। মেয়েটা এত রাগল কেন?
মিতু বলল, আপনি হাসছেন কেন?
হাসব না?
না হাসবেন না। এবং আপনি চলে যাবেন।
দুপুরে যে খাবার দাওয়াত ছিল সেটা বাতিল।
হ্যাঁ বাতিল। ধরে নিন আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি।
আচ্ছা যাও ধরে নিলাম। বিদায়।
হ্যাঁ বিদায়।
আপনাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করব। রাখবেন? প্লীজ।
অনুরোধ কর। রাখব।
মিতু বলল, আমার ধারণা। আপনি এই বাড়ি থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। ফিরে আসার জন্যে আমি আপনাকে টেলিফোনের পর টেলিফোন করতে থাকব। আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ আপনি টেলিফোন ধরবেন না। আর যদি ধরেন ও ফিরে আসবেন না। ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
প্রমিজ?
হ্যাঁ প্রমিজ।
আমি পার্কে বসে আছি। দ্যা গ্রেট জিতু মিয়া মাথা মালিশ করে দিচ্ছে। শুধু যে মাথা মালিশ করছে তাই না–
গানও শুনাচ্ছে। সবই সিনেমার গান। কোন ছবিতে গানটা আছে, কোন নায়িকা গান গেয়েছেন গানের আগে সেই ধারাভাষ্যও আছে।
ওস্তাদ এখন যে গানটা করব এইটা রিয়াজ ভাই গাইছে।
রিয়াজ ভাই কি সিনেমা লাইনের কেউ?
অবশ্যই। হিট হীরু। ছবির নাম দুই দুয়ারী।
নাম তো খারাপ না।
নাম খারাপ না হইলেও ছবি খারাপ। ফিনিসিং নাই। এক হিরুইন ডাবল হীরু। ডাবল হীরুর ছবি ভাল হয় না।
তাই না-কি?
সিঙ্গেল হীরুইন ডাবল হীরুর সব ছবি ফ্লপ হইছে।
কারণটা কি?
আল্লাপাকের ইশারা হইতে পারে। আল্লাপাকে ডাবল জিনিস পছন্দ করে না। উনার পছন্দ সিঙ্গেল। ঠিক না?
ঠিক হতে পারে। তুই গান শোনা।
মিতু মিয়া গান ধরার আগেই টেলিফোন বাজল। মিতু টেলিফোন করেছে।
হ্যালো মিতু! কেমন আছ?
জ্বি ভাল আছি।
দুপুরের রান্না হয়ে গেছে।
জ্বি হয়েছে।
নিজের হাতেই রেঁধেছা?
হ্যাঁ।
যে সব আইটেম বলেছিলাম, সব রান্না হয়েছে।
শুধু ইলিশ মাছের ডিমটা হয়নি। হিমু সাহেব শুনুন আপনাকে কি বলেছি সেটা মাথায় রাখবেন না। আমি হাত জোর করছি আপনি চলে আসুন। রান্না-বান্নার অভ্যাস আমার নেই–তারপরেও প্রতিটি আইটেম আমি রান্না করেছি। আপনি কোথায় আছেন বলুন আমি গাড়ি নিয়ে এসে আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাব। আপনি কোথায়?
আমি যে জায়গায় আছি। পার্শি ভাষায় তাকে বলে–পারিদায়েজা। পারিদায়েজ হচ্ছে চমৎকার বাগান। যে বাগানে পাখি গান করে। প্যারাডাইজ শব্দটা এসেছে পারিদায়েজা থেকে।
আপনি আসবেন না?
আমি টেলিফোন বন্ধ করে দিয়ে জিতু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, গান শুরু কর।
দুবছর পরের কথা
দুবছর পরের কথা। দুবছরে কী কী ঘটল। তার সংক্ষিপ্তসার।
ক. খালুজান ঠিক করেছেন বাদলের বিয়ে দেবেন। তাঁর ধারণা, বিয়ে হলো বাদলের একমাত্র ওষুধ। সেই ওষুধের ব্যবস্থা হয়েছে। যে-মেয়েটির সঙ্গে বিয়ের কথা মোটামুটিভাবে পাকা হয়েছে তার নাম আফরোজা। হোম ইকোনমিক্সে পড়ে। তার হাসি-সমস্যা আছে। তাকে যা-ই বলা হয়। সে হাসে। বাদল তাকে যখন মতি মিয়ার গল্প বলেছে, তখনো নাকি ভয় পাওয়ার বদলে সে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়েছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে বাদল চিন্তিত। আমার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছিল। আমি তেমন কিছু বলতে পারিনি।
বাদল আহত গলায় বলল, এমন ভয়ঙ্কর ভৌতিক কাহিনী শুনলে গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাবার কথা, অথচ আফরোজা হাসছে। এর মানে কী, হিমু ভাইজান?
আমি বললাম, মেয়েটা মনে হয় তোর কথা বিশ্বাস করেনি।
কী করা যায় বলো তো?
যেখানে আমরা মতির ডেডবডি ফেলে এসেছিলাম, সেখানে তাকে নিয়ে যা। সন্ধ্যাবেলা নিয়ে যাবি। নতুন পরিবেশে গল্পটা আবার বলে দ্যাখ। ভৌতিক গল্পে পরিবেশ খুবই ইম্পটেন্ট।
আমি একা তাকে ওই জায়গায় নিয়ে যাব? অসম্ভব। তুমি সঙ্গে গেলে যেতে পারি।
তোদের মাঝখানে আমার কি হাইফেন হিসেবে থাকা ঠিক হবে?
অবশ্যই ঠিক হবে। তা ছাড়া আফ তোমাকে দেখতে চায়।
আফটা কে?
বাদল লজ্জিত গলায় বলল, আফরোজাকে আমি সংক্ষেপে আফ বলি। নামটা ভালো হয়েছে না?
তোকে সে সংক্ষেপ করে কী ডাকে? বাদল সংক্ষেপে হয় বাদ। তোকে কি বাদ ডাকে?
বাদল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তাকে খুবই আনন্দিত মনে হলো।
এক সন্ধ্যায় বাদ এবং আফকে নিয়ে উপস্থিত হলাম মাওনায়।
সেখানে রাস্তার পাশে বাধানো কবর, দানবাক্স, শালু কাপড়ের চাদর, মোমবাতি-সবই পাওয়া গেল। জানা গেল। কবরটা অচিন পীরের। পীরসাহেব খুবই গরম। তিনি বেয়াদবি সহ্য করেন না। তবে খাস দিলে কেউ কিছু চাইলে অচিন বাবার সুপারিশে তা পাওয়া যায়। হুজরাখানার খাদেমের সঙ্গেও কথা হলো। খাদেমের নাম মুনশি খলিলুল্লা। খাদেম যা বললেন তা হলো, বছর দুই আগে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে এক নুরানি চেহারার মানুষ তাকে বলছেন, ওরে, রাস্তার পাশে আমি শুয়ে আছি। তুই আমাকে কবর দে। এইখানে মাজার হোক। তুই তার প্রধান খাদেম।
আমি বললাম, মাজারের আয়-রোজগার কেমন?
খাদেম সাহেব বললেন, আয় ভালো। সব বাস এখানে থামে। যাত্রীরা দান-খয়রাত করে। শহর-বন্দরেও খবর পৌঁছে গেছে। শহর-বন্দর থেকে লোকজন আসে। এই যেমন আপনারা এসেছেন।