ফিহা তোমাকে খুব পছন্দ করেন জেনে আনন্দিত হচ্ছি। ফিহা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না, তবু আমাকেই বইটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে।
গেটের জানালা বন্ধ হয়ে গেল। পাঠক ধুপ ধুপ শব্দে ফিরে যাচ্ছে। মারলা লি লক্ষ করলেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। তাপমাত্রা আরো নেমে গেছে। তিনি গাড়ির ভেতর গিয়ে বসবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। পাঠক নামের এই রোবটটি কতক্ষণে ফিরবে কে জানে। পি আর ধরনের রোবট। এদের কাজকর্ম ঢিলেঢালা ধরনের, তবে এদের লজিক খুব উন্নত। তারচে বড় কথা এর আশেপাশের জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণ করে। যতই দিন যায় ততই এদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।
গেট খুলে গেল। পাঠক বলল, ভেতরে আসুন স্যার। ফিহা লাইব্রেরি ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনাকে খুব সাবধানে আসতে হবে। ভেতরে আলো নেই। ইচ্ছা করলে আপনি আমার হাত ধরতে পারেন।
মারলা লি শান্ত স্বরে বললেন, হাত ধরার প্রয়োজন নেই। তুমি আগে আগে যাও।
ফিহা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মনের বিরক্তি গোপন করার কিছুমাত্ৰ চেষ্টা করলেন না। মারতা লি বললেন, এত রাতে কাউকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। আমি নিজেই বইটি নিয়ে এসেছি। যদিও জানি অনধিকার চর্চা হয়েছে। আমি একজন মেন্টালিস্ট আপনার বাড়ির এক হাজার গজের ভেতরে আমার আসার কথা না। তবু এসেছি।
একজন রোবটকে দিয়ে বইটি আপনি পাঠাতে পারতেন।
জ্বিনা, পারতাম না। এই বই অন্যের হাতে দেয়া সম্ভব না।
ফিহা হাত বাড়িয়ে বই নিলেন। মারলা লি বললেন, আপনার জন্যে এক প্যাকেট কফি এনেছি। যে কোনো কারণেই হোক আগের প্যাকেটটি আপনি ফেলে দিয়েছিলেন।
ফিহা কফির প্যাকেট হাতে নিলেন। মারতা লি বললেন, বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। লক্ষ করেছেন কিনা জানি না, বৃষ্টি পড়ছে। গরম এক কাপ কফি খেলে আমার জন্যে ভালো হত।
বসুন। কফি দিতে বলি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মারলা লি বসলেন। ফিহা বসলেন না দাঁড়িয়ে রইলেন। বসতে ইচ্ছা করলেও অবিশ্য বসার উপায় নেই। একটিই চেয়ার। মারলা লি বললেন, আপনি বসবেন না ফিহা?
বসার প্রয়োজন কি আছে?
মুখোমুখি বসলে কিছুক্ষণ কথা বলতাম। শত্রুপক্ষের সঙ্গেও তো মানুষ। দুএকবার কথা বলে। তাছাড়া বাড়িতে ঢােকার অনুমতৃি যখন দিয়েছেন। কথা বলার অনুমতিও দেবেন।
ফিহা লাইব্রেরি ঘর থেকে বের হয়ে পাঠককে বললেন আরেকটি চেয়ার লাইব্রেরি ঘরে দিতে।
পাঠক বলল, চেয়ার টানাটানি করা আমার জন্যে সম্মান হানিকর। রাঁধুনী রোবটকে এই কাজটা করতে বলি?
বল।
আরেকটা কথা স্যার, মনে হচ্ছে এই মানুষটি আপনাকে খুব বিরক্ত করছে। দ্রতার কারণে আপনি তাকে চলে যেতে বলতে পারছেন না। আমাকে যদি অনুমতি দেন তাহলে কথার পঁাচে ফেলে লোকটাকে বিয়ে করব। আপনার দ্রতাও রক্ষা হবে।
তার প্রয়োজন দেখছি না। তুমি আড়ি পেতে কথা শুনছিলে এ ব্যাপারটিও আমার অপছন্দের। যাও গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।
পাঠক চলে গেল। তার ইরিডিয়াম চোখের উজ্জ্বলতা কিছুটা ম্লান হয়েছে।
মারলা লি বললেন, আপনার বিশাল লাইব্রেরিতে একটি মাত্র চেয়ার দেখে বিস্মিত হয়েছি।
ফিহা বললেন, বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমি একা মানুষ।
আমিও একা মানুষ ফিহা; কিন্তু তাই বলে আমার বসার ঘরে বা আমার লাইব্রেরিতে একটি মাত্র চেয়ার থাকবে তা কল্পনাও করতে পারি না।
আপনি ফিহা নন বলে কল্পনা করতে পারেন না। আমি পারি, এবং আমার কাছে এটিই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। আমার লাইব্রেরি ঘর কফি খাবার কিংবা আড়া দেবার জায়গা নয়।
এখানে বসে কথা বলতে যদি আপনি অসুবিধা বোধ করেন তাহলে আমরা অন্য কোথাও বসতে পারি।
আপনাকে কি কথা বলতেই হবে?
বলতে পারলে ভালো হত। আপনি না চাইলে বলবেন না।
আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।
বেশ। আমি কফি শেষ করেই বিদেয় হব।
মারল লি নিঃশব্দে কফি শেষ করলেন। মাথার টুপি খুলে টেবিলে রেখেছিলেন। টুপি মাথায় দিলেন। শান্ত গলায় বললেন, বিদায় নিচ্ছি। শুভরাত্রি মহামতি ফিহা।
শুভরাত্রি।
মারল লি পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালেন না, থমকে দাঁড়ালেন। আগের চেয়েও শান্ত গলায় বললেন, আমি কিন্তু ইচ্ছা করলেই আমার কথা শুনতে আপনাকে বাধ্য করতে পারতাম। আমি একজন মেন্টালিস্ট। আমি চাইলে, আপনার না বলার ক্ষমতা নেই। আমি আপনাকে বাধ্য করতে পারতাম, তা কিন্তু করিনি। মেন্টালিস্টরা কখনোই কাউকে বাধ্য করে না। তারপরেও সাধারণ মানুষদের ভেতর ভয়াবহ ভুল ধারণা যে মেন্টালিস্টরা তাদের ইচ্ছা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়।
সেনাবাহিনী কি পুরোপুরি আপনারা নিয়ন্ত্রণ করেন না?
অবশ্যই করি। প্রয়োজনেই করি। নিয়ন্ত্রণ না করলে সেনাবাহিনী দুভাগ হয়ে যেত। একটি সাধারণ মানুষদের বাহিনী অন্যটি মেন্টালিস্টদের বাহিনী। তার ফলাফল নিশ্চয়ই আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না।
ফিহা বললেন, পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারে একটি বিশেষ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। আপনারা সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। গবেষণা এগুতে দিচ্ছেন না।
সঠিক তথ্য কিন্তু ভুল ব্যাখ্যা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ ঝড় আসছে। শক্তিশালী টর্নেডো। ঝড় শেষ হলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হবে। আমাদের প্রতি আপনার যত বিদ্বেষই থাকুক আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে আমরা কোনো রকম গবেষণায় বাধা দেই না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের মধ্যে কোনো বিজ্ঞানী নেই। মেন্টালিস্টরা সষ্টিশীল কাজ পারে না। যারা এই কাজটি পারে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সীমা নেই। আপনি নিজের কথা ভেবে দেখুন মহামতি ফিহা। কি পরিমাণ সম্মান আপনি ভোগ করেন?