ফিহা দ্বিতীয়বার বললেন, চুপ কর।
তিনি জানেন পাঠক চুপ করবে না। তবে অসুবিধা নেই। তিনি এখন তাঁর শোবার ঘরে ঢুকে যাবেন। পাঠক শোবার ঘরে ঢুকবে না। তাকে সে অনুমতি দেয়া হয় নি। সে খাবার ঘরে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করবে ফিহার জন্যে। ফিহার দেখা পেলে কোনো একটা আলাপ শুরুর চেষ্টা করবে। ফিহা ঠিক করলেন তাকে এই সুযোগ দেবেন না। শোবার ঘর থেকে বের হবেন না। তাঁর মন বেশ খারাপ। খেতেও ইচ্ছা করছে না। মেন্টালিস্টদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেই তাঁর মেজাজ আকাশে চড়ে যায়।
শোবার ঘরের চেয়ারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে তিনি মত বদলালেন। নিজেকে কষ্ট দেবার কোনো মানে হয় না। খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে। পাঠকের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও করা যায়। বেচারা গল্প করতে পছন্দ করে। গল্প করার সঙ্গী নেই।
ফিহা খাবার ঘরে ঢুকলেন।
পাঠক সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি কি কথা বলতে পারি স্যার?
না।
ফিহা খেতে বসলেন। আজও লবণ কম হয়েছে। শুধু কম না, বেশ কম। অথচ দুদিন আগে প্রতিটি খাবারে অতিরিক্ত লবণ ছিল। এই রোবটটা মনে হয় বদলানো দরকার। ফিহা বিরক্ত মুখে বললেন, লবণের জন্যে তো কিছু মুখে দিতে পারছি না। তুমি কি লবণের ব্যাপারটা কিছুতেই ঠিক করতে পারবে না?
লীম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার কিছু বলার নেই। পাঠক বলল, লবণ প্রসঙ্গে আমি কি একটা ছোট্ট কথা বলতে পারি স্যার?
না।
আপনার নিষেধ অগ্রাহ্য করেই কথাটা বলার ইচ্ছা হচ্ছে, যদিও জানি তা সম্ভব না। আপনাকে আবারো অনুরোধ করছি লবণ সম্পর্কে আমাকে কথাটা বলতে দিন।
বল।
আমাদের রোবট লীম লবণের পরিমাণে কোনো ভুল করে না। সমস্যাটা আপনার।
সমস্যা আমার মানে?
আপনার যখন মন-টন ভালো থাকে, তখন আপনি লবণ কম খান। আবার যখন মেজাজ খারাপ থাকে লবণ বেশি খান। আমি দীর্ঘ দিন পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। মনে হয় মেজাজ খারাপ থাকলে আপনার শরীর বেশি ইলেকট্রোলাইট চায়। শরীরবিদ্যার কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করা যায়। আমি চারজন বিশেষজ্ঞের ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনি কি কথা বলতে চান?
কথা বলতে চাই না। বাইরে গেলেই আপনার মেজাজ খারাপ হয় এর কারণ কি?
ফিহা জবাব দিলেন না। পাঠক বলল, মেন্টালিস্টদের নিয়ে আপনি কি খুব বেশি চিন্তা করেন?
না। তুমি কথা বলা বন্ধ কর।
এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে যদি আপনার খারাপ লাগে তাহলে অন্য বিষয়ে কথা বলি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্যরহস্য নিয়ে কি স্যার আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করব?
পাঠক!
জ্বি স্যার।
তোমার কথা বলার জন্যে কি এখন সঙ্গী দরকার?
পাঠক প্রথমবারের মতো প্রশ্নের জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। ফিহা বললেন, নুহাশ নামে একজন তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। শতকরা কুড়িভাগ সম্ভাবনা সে এ বাড়িতে আসবে। যদি আসে তুমি কথা বলার সঙ্গী পাবে।
আমি স্যার শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলাতেই আগ্রহ বোধ করি।
কেন?
আমি চিন্তা করছি আপনার একটা জীবনী লিখব। জীবনী লেখার জন্যে আপনার সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রয়োজন। তথ্য তেমন কিছু নেই। তাই সারাক্ষণ কথা বলতে চেষ্টা করি, যদি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কোনো তথ্য পেয়ে যাই।
কিছু পেয়েছ?
জ্বি স্যার।
কি পেলে?
আমি যে অল্প কয়েক পাতা লিখেছি আপনি কি পড়তে চান?
না।
আপনার জীবনী গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি যে না শব্দটা আপনার প্রিয়। যখন তখন আপনি না বলেন। মাঝে মধ্যে কিছু না ভেবেই বলেন। জীবনী গ্রন্থের শুরুটা একটু দেখে দিলে ভালো হয়। অনেক মজার মজার জিনিস সেখানে আছে। যেমন ধরুন, শুরুতেই একটা চমক আছে। পাঠক শুরুর কয়েকটি লাইন পড়েই চমকে উঠবে–
শুরুটা কি?
শুরু হচ্ছে—মহামতি ফিহা বড় হয়েছেন একটি মেন্টালিস্ট পরিবারে। এই পরিবারটি ফিকে অনাথ আশ্রম থেকে তুলে নিয়েছিলেন। পরম আদর এবং মমতায় ফিকে তাঁরা লালন পালন করেন। অসাধারণ প্রতিভাধর এই বালকটির প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে মেন্টালিস্ট পরিবারের ভূমিকাকে ছোট করে। দেখার কোনো উপায় নেই। বার বছর বয়সে ফিহা ঐ মেন্টালিস্ট পরিবার ছেড়ে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে কোনোদিনও তিনি তাঁর পালক পিতা-মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি।
পাঠক থামল। ফিহা মূর্তির মতো বসে আছেন। পাঠক বলল, আমি কি কোনো ভুল তথ্য দিয়েছি স্যার?
না। সব ঠিকই আছে।
জীবনী গ্রন্থের ভাষাটা আপনার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?
ভাষার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
আমি জীবনী গ্রন্থটি কয়েক ধরনের ভাষা ব্যবহার করে লিখেছি। একই জিনিস খুব কাব্যিকভাবেও লিখেছি। যেমন…
ফিহা উঠে পড়লেন। পাঠকও উঠে দাঁড়াল। ফিহা বললেন, পাঠক, তুমি আমার মেন্টালিস্ট বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। বলবে, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
এটা তো স্যার সম্ভব না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। তাঁদের একটা ইন্টারভ্যু নেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভূগর্ভস্থ মেন্টালিস্টরা সবার যোগাযোগের বাইরে।
ফিহা শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। অস্থির ভাব আবার ফিরে এসেছে। শুধু ফিরে এসেছে তাই না। দ্রুত বাড়ছে। তিনি এই অস্থিরতার ধরন জানেন। এ অন্য ধরনের অস্থিরতা। ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনি কি নিজেকে শান্ত করবেন? না, তার প্রয়োজন নেই। অস্থিরতার প্রয়োজন আছে। তিনি সময় সমীকরণের খুব কাছাকাছি আছেন। তিনি জানেন তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছে। সমীকরণের সমাধান অবচেতন মনের কাছে চলে এসেছে। চেতন মন বা তার জাগ্রত সত্তা সেই সমাধান এখনো পায় নি। তবে পেয়ে যাবে। খুব শিগগিরই পেয়ে যাবে। এখন প্রয়োজন নিজেকে শান্ত রাখা। সর্বযুগের সর্বকালের সবচে বড় আবিষ্কারটির মুখখামুখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।