আমাকে চিনতে পারছ আশা করি।
নুহাশ জবাব দিচ্ছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
তোমার জন্যে এক প্যাকেট কফি নিয়ে আসছিলাম। ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি বলে আনা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে আনলেও হত। তুমি কি আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে, না দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে?
নুহাশ তাকিয়ে আছে। কথা বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। ফিহা বললেন, আমার অবশ্যি ভেতরে যাবার তেমন প্রয়োজন নেই। তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলা দরকার। বলে চলে যাব। খুব মন দিয়ে শোন। তার আগে জানা দরকার তুমি কি বিবাহিত?
নুহাশ না-সূচক মাথা নাড়ল।
ফিহা বললেন, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই নিলাম। কোনো তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। একমাত্র তোমার সঙ্গেই সামান্য পরিচয়। কাজেই আমি এসেছি তোমার কাছে। যদি আমাকে তোমার পছন্দ হয়, যদি মনে হয় আমাকে বিয়ে করা যেতে পারে তাহলে আমার কাছে চলে আসবে। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। অসময়ে আসার জন্যে লজ্জিত।
নুহাশ কঁপা গলায় বলল, একটু বসে যান।
ফিহা বললেন, না বসব না। তুমি আমার কারণে তোমার একটি প্রিয় গ্রন্থ ছিড়েছ। তা ঠিক হয়নি। যে প্রিয় সে সব সময় প্রিয়। আমি খারাপ বললেই কি প্রিয়জন অপ্রিয় হবে? তুমি অবশ্যই আরেকটি বই কিনে নেবে। মনে থাকবে?
নুহাশ হাসছে। লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে। ফিহা তা লক্ষ করলেন না। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। নুহাশ এখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখন দেখাচ্ছে রোবটের মতে, চোখের পলক ফেলছে না।
ফিহা রাস্তায় নেমে পুরো ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলেন। এটা নিয়ে এখন তিনি আর ভাববেন না। মেয়েটা যদি সত্যি আসে তখন দেখা যাবে। শুধু শুধু চিন্তা ভাবনা করার কোনো মানে হয় না। তাঁর অনেক কাজ।
এরিন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিহা বললেন, তুমি আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দাও। তুমি করে বলায় রাগ করনি তো?
এরিন হাসল। সুন্দর দেখাল এরিনকে। হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায়।
এরিন তুমি কেমন আছ?
জ্বি ভালো।
এই চাকরি কি তুমি পছন্দ কর।
করি।
তুমি কি বিবাহিত?
না। পুলিশদের বিয়ে করার নিয়ম নেই।
কাদের তৈরি নিয়ম এরিন?
মেন্টালিস্টদের নিয়ম।
গাড়ি ছুটে চলেছে। ফিহার ঝিমুনি ধরে গেছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
ফিহার বাড়িটা প্ৰকাণ্ড। অনেকটা দুর্গের মতো। উঁচু পাচিল, পাঁচিলের উপর কাঁটা তার। পাঁচিল থেকে এক হাজার গজ দূরে মূল রাস্তায় সাইনবোর্ড লাগানো।
মেন্টালিস্টদের প্রবেশ কাম্য নয়।
আমি নীরবতা পছন্দ করি।
ফিহা
এ জাতীয় লেখা ফিহার পক্ষেই লেখা সম্ভব। মেন্টালিস্টরা এই পথে যাওয়াআসা করে। সাইবোর্ড দেখে। কেউ কেউ এক মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়। তবে কখনো বলে না, এ জাতীয় সাইনবোর্ডের মানে কি? মেন্টালিস্টদের প্রধান গুণ তারা অভিযোগ করে না, বিরক্তি প্রকাশ করে না এবং কখনোই রাগ করে না। তাছাড়া ফিহার উপর রাগ করার প্রশ্ন উঠে না। উনি এসবের ঊর্ধ্বে। অন্যের রাগ ভালবাসা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।
মানুষটি জন্ম থেকেই নিঃসঙ্গ। বিশাল বাড়িটায় থাকেন একা। মাঝখানে কিছুদিন কুকুর পুষেছিলেন। দুটি শিকারী কুকুর, এদের পছন্দ করতেন। এক গভীর রাতে টাইম ডিপেনডেন্ট ইরেটা ফাংশান নিয়ে ভাবছিলেন। কুকুরের ডাকে চিন্তা এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি বিরক্ত মুখে হুকুম দিলেন কুকুর দুটাকে এই মুহূর্তে বিদেয় কর। কুকুর বিদেয় হয়ে গেল। তারপর পাখি পোর শখ হল। চার পাঁচ ধরনের পাখি যোগাড় হল। এক সময় তাদের চিৎকারও অসহ্য বোধ হল। এখন আর পাখি নেই—খাঁচা পড়ে আছে।
এ বাড়িতে বর্তমানে কোনো মানুষ নেই। তিনটি রোবট আছে। তিনটিই কর্মী রোবট। দুজনের বুদ্ধিশুদ্ধি নিচের দিকে। নিজের কাজ ছাড়া অন্য কিছু প্রায় জানে না বললেই হয়। একটি রোবটের দায়িত্ব হচ্ছে ঘর গুছিয়ে রাখা এবং রান্না করা। তার নাম লীম লীম দিনরাত এইটি করে। খুব যে ভালো করে তাও না। রান্নায় লবণের পরিমাণ কখনোই ঠিক হয় না। বাকি দুটি রোবটের একটির কাজ বাড়ি পাহারা দেয়া। সে ক্রমাগত বাড়ির চারদিকে হাঁটে। তৃতীয় রোবটের কোনো কাজকর্ম নেই। এই রোবটটি PR টাইপের। বুদ্ধিবৃত্তি বাকি দুজনের মতো নিচের দিকে নয় বরং বেশ ভালো। ফিহা তাকে কিনেছিলেন নিজের কাজে সাহায্য করার জন্যে। শেষটায় মত বদলেছেন। রোবটের সাহায্য তার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। এখন রোবটটার কাজ হচ্ছে দিনরাত বারান্দায় বসে বই পড়া। ফিহা একে খানিকটা পছন্দ করেন। পাঠক নামে ডাকেন। মাঝে মধ্যে ডেকে কথাবার্তা বলেন। PR টাইপের রোবটের বড় ত্রুটি হচ্ছে এরা গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। অপ্রয়োজনে দীর্ঘ বাক্য বলে। কথা বলতে এরা পছন্দ করে। ফিহা বাইরে থেকে এলে চেষ্টা করবে একগাদা কথা বলতে।
আজ ফিহা গেট দিয়ে ঢুকতেই সে এগিয়ে গেল এবং একঘেয়ে গলায় বলল, স্যার আজ আপনি দুঘণ্টা একত্রিশ মিনিট বাইশ সেকেন্ড বাইরে কাটিয়েছেন। ন তারিখ আপনি বাইরে ছিলেন। সেদিন আপনি ছিলেন এক ঘণ্টা চল্লিশ সেকেন্ড। আবার তিন তারিখে…
চুপ কর।
পাঠক চুপ করে গেল। তবে তাও অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। ফিহার পেছনে পেছনে আসতে আসতে বলল, স্যার, আপনার কি মনে আছে কাল রাতে আপনি বাগানে এসে বললেন, আজ তো আকাশে অনেক তারা। আপনার কথা শোনার পর আমি সিদ্ধান্ত নেই কোন সময় আকাশে তারা বেশি দেখা যায় তা বের করব। বের করতে গিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং কিছু মজার তথ্য…