কতজন মেন্টালিস্ট এ শহরে আছে তা জানেন?
তাও জানি না। তাদের সংখ্যা কখনো প্রকাশ করা হয় না। তবে এ শহরে। সাধারণ মানুষ এই মুহূর্তে আছে নব্দুই হাজার সাতশ এগারো জন।
গত বছরেও জনসংখ্যা ছিল এক লাখ কুড়ি হাজারের মতো। কমে গেল কেন?
আমার জানা নেই স্যার।
আপনার সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হচ্ছে তা মেন্টালিস্টরা বুঝতে পারছে? পারছে স্যার। পুলিশের উপর এদের সরাসরি নিয়ন্ত্ৰণ আছে।
মেন্টালিস্টদের আবাসিক এলাকা কি একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ না সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে?
এরা বাস করে ভূগর্ভস্থ শহরে। সেই শহর কত বড়, কতটুকু ছড়ানো তা আমরা জানি না স্যার। আগে কেউ কেউ বাইরে থাকত, এখন নেই বললেই চলে।
আপনার নাম কি?
এরিন।
এরিন, আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে আমরা মানুষ হিসেবে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছি? একদল থাকছে মাটির উপরে, একদল চলে গিয়েছে মাটির নিচে।
এইসব নিয়ে আমি ভাবি না স্যার।
কেউই ভাবে না। কেন ভাবে না বলুন তো?
জানি না স্যার।
ফিহা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমাদের ভাবতে দেয়া হয় না। আমাদের ভাবনা, আমাদের কল্পনা নিয়ন্ত্রিত। আমরা কি ভাবব মেন্টালিস্টরা তা ঠিক করে দেয়। যখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের সুখী হওয়া উচিত, আমরা সুখী হই। যখন ভাবে আমাদের অসুখী হওয়া উচিত, আমরা অসুখী হই।
কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কিন্তু স্বাধীনভাবেই চিন্তা করছেন।
হ্যাঁ তা করছি এবং অবাক হচ্ছি। আপনি আপনার গাড়ি নিয়ে আসুন, আমি একটা জায়গায় যাব। সাধারণ আবাসিক প্রকল্প। ১১৮ নম্বর কক্ষ। একটি অল্পবয়স্ক মেয়ের সঙ্গে কথা বলব বলে ভাবছি, মেয়েটির নাম নুহাশ।
এরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে গাড়ি আনতে রওনা হল। ফিহা দাঁড়িয়ে আছেন। প্রশস্ত রাস্তার এক পাশের ফুটপাতে। পনেরো মিনিট পর পর স্বয়ংক্রিয় ট্রাম যাচ্ছে, এ ছাড়া রাস্তায় যানবাহন বা লোক চলাচল নেই। প্রাণহীন একটি শহর। সারাদিন হেঁটেও তিনি কোনো শিশুর দেখা পান নি। শিশুসদনগুলি শহরের বাইরে। বাবা-মার সঙ্গে শিশুদের রাখা হয় না। তারা বড় হয় শিশুসদনে। বছরে একবার অল্পকিছু সময়ের জন্যে বাবা-মারা শিশুদের দেখতে যেতে পারেন।
আচ্ছা, মেন্টালিস্টদের শিশুরা কোথায় বড় হয়। তাদের শিশু সনদগুলি কোথায়? তিনি জানেন না। ফিহা ক্লান্ত বোধ করছেন। শীত লাগছে। আজ কত তারিখ, কি বার তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ছুটি ভোগ করছেন। ছুটির সময় কিছুই মনে রাখতে চান না। ছুটি কাটান শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, অরণ্য কিছুই দেখতে ইচ্ছা করে না।
তাঁর বয়স পঞ্চাশ। অনেকখানি সময়ই তিনি পার করে দিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে একবারও কেন মনে হল না বাইরে যেতে? মেটালিস্টরা সেই ইচ্ছা জাগতে দেয় নি। তিনি বিয়ে করেন নি। কখনো কোনো তরুণীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন নি। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। কেন করেছেন? মেন্টালিস্টরা কি তাকে প্রভাবিত করেছে? শুধু তিনি একা নন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিটি বিজ্ঞানীই চিরকুমার। তিনি একা হলে ব্যাখ্যা হয়তো অন্য রকম হত। তিনি তো একা নন।
মেন্টালিস্টরা বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করছে। কারণ বিজ্ঞানীদের কাজ তাদের প্রয়োজন। এই কাজ তারা আদায় করে নেবে। বিজ্ঞানীরা তাদের কাছে রোবট ছাড়া কিছুই নয়। একদল পুতুল, যে-পুতুলের সুতা মেন্টালিস্টদের হাতে।
মেন্টালিস্টরা এক সূক্ষ্মভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে তা ভেবে ফিহা অতীতে অসংখ্যবার বিস্মিত হয়েছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো হবেন। কিন্তু এখন আর বিস্মিত হতে ইচ্ছা করে না।
একবার গ্রেগরিয়ান এ্যানালাইসিস নিয়ে তিনি সমস্যায় পড়লেন। বিষয়টির উপর তাঁর তেমন দখল নেই। অথচ সময় সমীকরণে গ্রেগরিয়ান এ্যানালাইসিস অসম্ভব জরুরি। নতুন করে এই জিনিস শিখতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তায় বাধা পড়বে। এই অবস্থায় হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলেন গেরিয়ান এ্যানালাইসিসের বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক শরমন তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে এখানে আসছেন। তাঁর শরীর অসুস্থ। তিনি এখানে এসে শরীর সারাবেন।
এই ব্যবস্থা কি মেন্টালিস্টরা করে দিল না?
সব কিছুই তারা করে দিচ্ছে। সব কিছু এগুচ্ছে তাদের পরিকল্পনায়। তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়া কি খুব অসম্ভব? যা তাঁর ইচ্ছা করছে না সেই কাজটি করলে কেমন হয়?
তাঁর শহর ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না, শহর ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? নারীসঙ্গ তাঁর প্রিয় নয়, তিনি যদি এখন নুহাশ নামের মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলেন তাহলে কেমন হয়? অবশ্যি মেয়েটির তাতে মত থাকতে হবে। মত না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। বিজ্ঞানীরা স্বামী হিসেবে মোটেই আকর্ষণীয় নয়।
ফিহা আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর হাসি পাচ্ছে। হো হো করে খানিকক্ষণ হাসা যেতে পারে। না কি মেন্টালিস্টরা তাকে হাসতেও দেবে না?
এরিন গাড়ি নিয়ে এসেছে। সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু দেরি হল স্যার। অনেকদূর যেতে হবে তাই নতুন সেল লাগিয়ে নিয়ে এসেছি।
অনেক দূর যেতে হবে কি? জি স্যার। শহরের অন্যপ্রান্তে। চল, রওনা হওয়া যাক।
নুহাশ দরজা খুলল
নুহাশ দরজা খুলল।
ফিহা বললেন, কেমন আছ নুহাশ?
নুহাশ তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? সে কি ঘুমুচ্ছে? মানুষটিকে সে দেখছে ঘুমের মধ্যে?