তোমার কাছে কি একুশ লী নেই?
আছে। কিন্তু সামান্য কফির জন্যে এতগুলি লী খরচ করব কি-না তাই ভাবছি।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, এই যে ভাবনাটা তুমি ভাবছ তার মানে তুমি লজিক ব্যবহার করছ। যে মেয়ে লজিক ব্যবহার করে সে কীভাবে অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ পড়ে তা আমি বুঝতে পারছি না।
এই গল্পগুলির মধ্যেও এক ধরনের লজিক আছে। আপনি যেহেতু কোনোদিন এ জাতীয় গল্প পড়েননি আপনি বুঝতে পারছেন না। স্যার, আপনি এই বইটা নিয়ে যান, পড়ে দেখুন।
এ জাতীয় বই আমি আগে পড়িনি তা কি করে বললে?
আপনি হচ্ছেন মহামতি ফিহা। এ জাতীয় বই পড়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।
তুমি আমাকে চেন?
মেয়েটি হেসে ফেলে বলল, আপনাকে কেন চিনব না? আমি কি এই পৃথিবীর মেয়ে না?
কি নাম তোমার?
আমার নাম নুহাশ।
পড়াশোনা কর।
না। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির ক্যাটালগার।
পটে প্রচুর কফি আছে। তুমি ইচ্ছা করলে কফি খেতে পার।
ধন্যবাদ স্যার।
নুহাশ সাবধানে কফি ঢালল। কফির পেয়ালায় ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। ফিহার শুরুতে মনে হয়েছিল এই মেয়েটির চেহারা বিশেষত্বহীন। এখন তা মনে। হচ্ছে না। এর চেহারায় এক ধরনের মায়া আছে যা মানুষকে আকর্ষণ করে। ফিহার ভুরু কুঁচকে গেল। তাঁর চিন্তায় ভুল হচ্ছে। মায়া আবার কি? মায়া তৈরি হয় কিছু বিশেষ বিশেষ কারণে। এই মেয়েটির মধ্যে বিশেষ কারণের কি কি আছে? মেয়েটির কফি শেষ করে রুমালে ঠোট মুছতে মুছতে বলল, এত জঘন্য কফি আমি স্যার জীবনে খাইনি।
ফিহা হেসে ফেললেন। মেয়েটা সত্যি কথা বলেছে। মেয়েটির উপর মায়া তৈরি হবার একটি কারণ পাওয়া গেল, তার মধ্যে সারল্য আছে। আরেকটি জিনিস আছে—মেয়েটি লাজুক কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। লাজুক মানুষের আত্মবিশ্বাস কম থাকে।
স্যার আমি যাই? বইটা কি আপনি রাখবেন?
না। আমি আবর্জনা পড়ি না।
পড়তে হবে না স্যার। শুধু বইটা হাতে নিন। আপনি বইটা হাতে নিলে আমার ভালো লাগবে। আরব আমার খুব প্রিয় লেখক।
ফিহা কঠিন গলায় বললেন, বারবার এক ধরনের কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। তোমাকে তো একবার বলেছি এই আবর্জনা আমি হাত দিয়ে ছোব না।
নুহাশের মুখ কাল হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ চোখ ভিজে গেল। দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা তাঁর কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। এতটা রূঢ় তিনি না হলেও পারতেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের উপর দখল কমে আসছে। এটা ভালো কথা না। এই মেয়েটির একজন প্রিয় লেখক থাকতেই পারে। মেয়েটির প্রিয় লেখক যে তারও প্রিয় হতে হবে এমন তো কথা নেই।
স্যার আমি যাই? আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি।
মেয়েটা ঘর ছেড়ে যাচ্ছে। যে ভাবে ছুটে যাচ্ছে তাতে মনে হয় অবধারিতভাবে দরজার সঙ্গে ধাক্কা খাবে। হলও তাই। মেয়েটা দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেল।
পদার্থবিদ মহামতি ফিহা
পদার্থবিদ মহামতি ফিহা কাগজে বড় বড় করে লিখলেন, কফি পান করে তৃপ্তি পেয়েছি। নিচে নাম সই করলেন। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন কমিউন অফিসের দিকে। কমিউন কৰ্মাধ্যক্ষ মারলা লির সঙ্গে তাঁর আজ দেখা করার কথা। এপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল এগারোটায়। এখন বাজছে সাড়ে এগারো। আধ ঘণ্টা দেরি। তার জন্যে মারলা লি বিরক্ত হবেন না। বরং মধুর ভঙ্গিতে হাসবেন। মারলা লি একজন মেন্টালিস্ট। মেন্টালিস্টরা কখনো বিরক্ত হয় না। আজ পর্যন্ত শুনা যায়নি কোনো মেন্টালিস্ট উঁচু গলায় কথা বলেছে বা বিরক্তি প্রকাশ করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের বিরক্ত হবার প্রয়োজন নেই।
ফিহাকে সরাসরি মারলা লির ব্যক্তিগত ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘরটা অন্ধকার। জানালার ভারি পর্দা টান টান করে বন্ধ করা। দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বলছে। সে আলো যথেষ্ট নয়। ফিহা লক্ষ করেছেন সব মেন্টালিস্টদের ঘরই খানিকটা অন্ধকার। সম্ভবত এরা আলো সহ্য করতে পারে না। কিংবা এদের আলোর তেমন প্রয়োজন নেই।
ফিহা বললেন, আমি বোধহয় একটু দেরি করে ফেললাম।
মারলা লি হাসলেন। মেন্টালিস্টদের মধুর হাসি। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বিনয় এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন।
আপনি এসেছেন এতেই আমি ধন্য। আপনার জন্যে খাঁটি কফি তৈরি করা আছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের স্বাদহীন কফি নয়, ভালো কফি।
আমি কফির প্রয়োজন বোধ করছি না।
ফির মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। মেন্টালিস্টদের সামনে বসলেই এরকম হয়। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। জিভ হয়ে যায় কাগজের মতত। এটা তাঁর একার হয় না সবারই হয়, তা তিনি জানেন না। তিনি প্রচণ্ড রকম ক্ৰোধ এবং ঘৃণা নিয়ে মারলা লির দিকে তাকালেন। মানুষটা শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে অথচ এর মধ্যেই জেনে গেছে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি খেয়ে এসেছেন। মেন্টালিস্টরা তার মাথা থেকে যাবতীয় তথ্য কত সহজে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তিনি তাদের কিছুই জানতে পারছেন না। মারলা লি এই মুহূর্তে কি ভাবছে তা তিনি জানেন না। অথচ সে জানে তিনি কি ভাবছেন। এরা মেন্টালিস্ট। এদের কাছ থেকে কিছুই গোপন করা যায় না। এরা কোনো এক বিচিত্র উপায়ে অন্যের মাথার ভেতর থেকে সমস্ত তথ্য বের করে নিতে পারে। পদ্ধতিটি টেলিপ্যাথিক। তা কি করে কাজ করে ফিহা জানেন না।
মারলা লি বললেন, মহামতি ফিহা, আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?