বৃদ্ধ মিরান আবার মাথা নাড়লেন, আবার হাত ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। ফিহা বসলেন না।
দাড়িয়ে রইলেন। দুজনকে দেখে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। এতটা কষ্ট তাঁর হবে তা কখনো কল্পনা করেননি। তাঁর চোখ ভিজে উঠল। তিনি কোমল গলায় বললেন, যতদিন পদার্থবিদ্যা বেঁচে থাকবে আপনার নাম বেঁচে থাকবে। আমি আপনাদের ছেড়ে এসেছি কিন্তু আপনাদের ভালবাসার অমর্যাদা করি নি। আমি মেন্টালিস্টদের ঘৃণা করি। তারা আমাদের রোবট বানিয়ে রেখেছে। আপনারাও মেন্টালিস্ট। আমি আপনাদেরও ঘৃণা করি কিন্তু…
কিন্তু কি?
আপনাদের দুজনের প্রতি আমার ভালবাসারও সীমা নেই।
জানি।
কি করে জানেন?
আমরা মেটালিস্ট। আমরা দূর থেকে তোমার মন পড়তে পারি। চল্লিশ বছর ধরেই পড়ছি। চল্লিশ বছর ধরে তোমার মঙ্গল কামনা করছি।
আপনাদের ধন্যবাদ।
নুহাশ মেয়েটি ভালো। তুমি সুখী হবে।
আপনাদের আবারো ধন্যবাদ।
আমরা তোমার স্ত্রীর জন্যে ফুল আনিয়ে রেখেছি। ফুলগুলি নিয়ে যেও।
অবশ্যই নিয়ে যাবে।
ফিহা লক্ষ করলেন খাটের এক পাশে প্রচুর গোলাপ। টকটকে রক্তবর্ণের গোলাপ। ফিহার চোখ আবারো ভিজে উঠছে।
তুমি ছোটবেলায় যে সব খেলনা নিয়ে খেলতে তার কোনোটাই আমরা নষ্ট করিনি। তুমি কি সেগুলি দেখতে চাও?
না।
বৃদ্ধা এবার কথা বললেন। অতি ক্ষীণ স্বরে বললেন, খুব ছোটবেলায় তুমি পিঠে ব্যথা পেয়েছিলে। ছেলেবেলায় ক্ষত চিহ্ন ছিল। এখনো কি আছে?
আছে।
তুমি ছোটবেলায় বার বার ছুটে ছুটে আসতে, আমাকে বলতে, মা আমার ব্যথায় চুমু দিয়ে দাও। তোমার কি মনে আছে?
আছে।
তুমি যদি খুব লজ্জা না পাও তাহলে আমি সেখানে আরেকবার চুমু দিতে চাই।
ফিহা গায়ের কাপড় খুললেন। তাঁর কোনো রকম লজ্জা লাগল না। বরং মনে হল এই তো স্বাভাবিক। বৃদ্ধা গভীর আবেগে চুমু খেলেন। বৃদ্ধার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। ফিহা বললেন, যাই।
আর একটু বস। আমার পাশে বস।
ফিহা বসলেন। বৃদ্ধ বললেন, আমার হাত ধরে বস। পক্ষাঘাত হয়েছে। আমি হাত নাড়াতে পারি না। পারলে আমি তোমার হাত ধরতাম। ফিহা বৃদ্ধের হাত ধরলেন।
বৃদ্ধ বললেন, তুমি সময় সমীকরণের সমাধান করতে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
তুমি চাচ্ছ অতীতে ফিরে যেতে। যাতে আদি মেন্টালিস্ট তৈরির এক্সপেরিমেন্ট কেউ করতে না পারে।
আপনারা মেটালিস্ট। আমি কি ভাবছি তার সবই আপনারা জানেন।
হ্যাঁ জানি। কিন্তু তুমি জান না তোমার চিন্তায় বড় ধরনের ভুল আছে। তুমি যেই মুহূর্তে সমাধান বের করবে সেই মুহূর্তে মেন্টালিস্টরা তা জেনে যাবে। অতীতে তুমি যেতে পারবে না ফিহা, তোমাকে যেতে দেয়া হবে না। তোমার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে একটি রোবট পাঠানো হবে। তাকে মেন্টালিস্ট তৈরির বিদ্যা শিখিয়ে দেয়া হবে। এই ভাবেই চক্র সম্পন্ন হবে।
আপনি নিশ্চিত?
হ্যাঁ।
চক্ৰ ভাঙা যাবে না?
তুমি যদি সময় সমীকরণ বের না কর তাহলেই চক্র ভেঙে যাবে। অতীতে কেউ যেতে পারবে না। মেন্টালিস্ট তৈরি হবে না। চক্র সম্পূর্ণ করার জন্যেই তোমাকে দরকার। ধর্মগ্রন্থে তা আছে।
ধর্মগ্রন্থে কি আছে?
ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে—জ্ঞানী শত্রুদের প্রতি মমতা রাখিও কারণ জ্ঞানী শত্ৰুরা জগতের মহৎ কৰ্ম সম্পাদন করে। তোমাদের মহা শত্ৰুর কারণেই তোমরা চক্র সম্পন্ন করবে। সে মিরানের পালক পুত্র। সে জ্ঞানী।
ধর্মগ্রন্থে আমার উল্লেখ আছে বলেই কি মেন্টালিস্টরা আমাকে আলাদা করে দেখে?
হ্যাঁ। তোমার জ্ঞান তাদের প্রয়োজন। তোমার জ্ঞান ছাড়া চক্র সম্পূর্ণ হবে না।
ফিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃদ্ধা বললেন, আমরা দুজন সর্বশক্তি দিয়ে তোমার মস্তিষ্ক রক্ষা করে চলেছি। চল্লিশ বছর ধরেই করছি। যে কারণে এখননা কেউ তোমার মস্তিষ্ক থেকে কিছু জানে না। আমরা বেশিদিন বাঁচব না। তখন সবাই জানবে। আমাদের যা বলার তোমাকে বললাম, এখন তুমি তোমার বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবে।
ফিহা বললেন, আমি আপনাদের ভালবাসি।
জানি। ভালবাসার কথা বলার প্রয়োজন হয় না।
বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা দুজনই কাঁদতে লাগলেন।
ফিহা দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি যদি মারা যাই তাহলে চক্র ভেঙে যাবে। কারণ সময় সমীকরণ বের হবে না।
বৃদ্ধ মিরান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
ফিহা বললেন, চক্র ভেঙে গেলে মেন্টালিস্ট তৈরি হবে না। মেন্টালিস্টদের বিষয়ে বই লেখা হবে না। মেন্টালিস্টদের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থের সমস্ত লেখা মুছে যাবে।
বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
আমার যে হঠাৎ আপনাদের কাছে আসার ইচ্ছা হল তার কারণ কি এই যে আপনারা আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। তুমি যেভাবে ভাঙতে চাচ্ছ সেভাবে তা সম্ভব নয়। এই কথাটি তোমাকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
আপনারা চান চক্র ভেঙে যাক?
চাই। এই চক্র অন্যায় চক্র।
আপনাদের কাছে কি কোনো বিষ আছে?
হ্যাঁ। আমরা জোগাড় করে রেখেছি। আমরা জানি তুমি চাইবে।
বৃদ্ধা বিষের শিশি বের করে আনলেন। দশ বছর ধরে তাঁরা এই শিশি আগলে রেখেছেন। এখন আর আগলে রাখার প্রয়োজন নেই।
ফিহা বললেন, বিষের ক্রিয়া কতক্ষণ পর শুরু হবে?
ঘণ্টা খানেক লাগবে। ক্রিয়া করবে খুব ধীরে ব্যথা বোধ হবে না। আমরা তোমাকে ব্যথা পেতে দেব না। তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে পৌছতে পারবে।
ফিহার হাতে একরাশ গোলাপ। বাড়ি ফিরছেন হেঁটে হেঁটে। বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন। তাঁর চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। তবু গভীর আনন্দে তাঁর মন পরিপূর্ণ। চক্র ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ংকর একটি চক্র ভেঙে যাচ্ছে। ফিহা দ্রুত পা ফেলতে চেষ্টা করছেন। যে করেই হোক নুহাশের কাছে পৌছতে হবে। তার গল্পটির শুরুটা হলেও শুনতে হবে। মনে হয় ভোর হতে বেশি দেরি নেই। চারদিকে আলো হতে শুরু করেছে। ফিহার হাতের ফুলগুলি রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। তিনি দূরে ঘন্টার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। কোত্থেকে আসছে।