আপনি কে?
স্যার আমি টহল পুলিশ। আপনি কোথায় যেতে চান বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি যদি আপনার পেছনে পেছনে আসি আপনার কি অসুবিধা হবে?
হ্যাঁ হবে। আমি একা হাঁটতেই পছন্দ করি। ভালো কথা, এরিন নামের একজন টহল পুলিশের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাকে কি একটা খবর দিতে পারবেন? তাকে কি বলবেন যে আমি বিয়ে করেছি?
এরিনকে খবর দেয়া যাবে না স্যার।
কেন?
ঝড়ের রাতে সে মারা গেছে। রাস্তায় ডিউটি ছিল। রাস্তা ছেড়ে কোথাও আশ্রয় নেবার অনুমতি ছিল না। কাজেই সে ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রাণ বাঁচানোর জন্যেও সে কোথাও যেতে পারে নি?
না। আমরা মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রিত।
ও আচ্ছা।
ফিহা এগিয়ে চললেন। টহল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে দেখছে তাঁকে।
ফিহা রাতের খাবার শেষ করলেন নিঃশব্দে।
নুহাশ তার মুখোমুখি বসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। অন্যদিন খাবার টেবিলের আশেপাশে লীম এবং পাঠক দুজনই থাকে। আজ তারা নেই।
নুহাশ বলল, আপনার খাবারে লবণের সমস্যা হয় বলে শুনেছি। লবণ কি ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
আপনাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে।
চিন্তিত না। আমার মন খারাপ হয়ে আছে। মেন্টালিস্টদের সঙ্গে দেখা হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
ওদের সঙ্গে দেখা না করলেই পারেন।
দেখা না করেও কি ওদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় আছে? এই মুহূর্তে আমরা দুজন যে কথা বলছি তা কি মেন্টালিস্টরা শুনছে না?
নুহাশ ক্ষীণ স্বরে বলল, খুব সম্ভব শুনছে।
আমার প্রায়ই ইচ্ছা করে আমরা সাধারণ মানুষরা পৃথিবীর কোনো এক নির্জন প্রান্তে চলে যাই। আমাদের নিজেদের একটি দেশ হোক। স্বাধীন দেশ।
নুহাশ কঠিন গলায় বলল, এ জাতীয় কথা আর কখনো বলবেন না। যারা এ জাতীয় কথা বলেছে বা ভেবেছে তাদের ভয়াবহ শাস্তির কথা কি আপনি জানেন না?
ফিহা চুপ করে গেলেন। হ্যাঁ, এই অপরাধের শাস্তির কথা তিনি জানেন। শাস্তি একটিই—জেল নয়, মৃত্যুদণ্ড নয়—মানসিকতা হরণ। অপরাধীর মাথা থেকে সমস্ত স্মৃতি নষ্ট করে দেয়া হয়। অপরাধী তখন পৃথিবীতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতই হয়ে যায়। সে কিছুই জানবে না। সব তাকে নতুন করে শিখতে হয়। সে হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে। এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক সহজ শাস্তি।
খাওয়া শেষ না করেই ফিহা উঠে পড়লেন। তাঁর আর খেতে ইচ্ছা করছে। না। নুহাশ বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করছে?
না। তুমি ঘুমুতে যাও। আমি কাজ করব।
কি কাজ করবেন?
অঙ্কের একটা মডেল তৈরি করার চেষ্টা করছি। ওটা শেষ করব।
আজ না করলে হয় না?
না, হয় না নুহাশ, এই জিনিসটা আমার মাথায় ঘুরছে, এটা শেষ না করে অন্য কোনো কিছুতেই আমি মন দিতে পারব না।
আপনি যখন কাজ করবেন তখন আমি কি আপনার পাশে বসে থাকতে পারি?
না, পার না। তুমি রাগ করো না নুহাশ।
আমি রাগ করি নি। তবে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে—
ফিহা বিস্মিত হয়ে বললেন, কি কথা?
রাতে আপনি যখন ঘুমুতে আসবেন তখন আমি আপনাকে একটা গল্প পড়ে শোনাব। অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ থেকে একটা গল্প। আপনাকে সেই গল্প শুনতে হবে।
আমি কখন ঘুমুতে আসি তার তো ঠিক নেই…
নুহাশ লজ্জিত গলায় বলল, যত রাতই হোক। আমি জেগে থাকব আপনার জন্যে।
ডাটা এন্ট্রির মাঝপথে আবারো বাধা পড়ল। কমুনিকেটরে যোগাযোগ করলেন মারলা লি।
মহামতি ফিহা।
কথা বলছি।
গভীর রাতে আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত।
কি বলবেন বলুন।
আপনি আপনার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আপনি বলেছিলেন ব্যবস্থা করা যাবে না।
এখন করা হয়েছে। এঁরা দুজনই গুরুতর অসুস্থ। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মৃত্যুপথযাত্রী মেন্টালিস্টদের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করা হয়। এঁরা দুজন আপনাকে দেখতে চাচ্ছেন। আপনি কি আসবেন?
আমি এক্ষুণি আসছি।
আপনার গেটের কাছে গাড়ি থাকবে।
ফিহা পাঠকের দিকে তাকালেন। পাঠক বলল, আমার মনে হয় আজ রাতে কাজটা করতে পারব না।
আমারো তাই মনে হচ্ছে। নুহাশের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাতে হবে। সে আমাকে কি এক গল্প না-কি পড়ে শোনাবে।
আপনি কখন ফিরবেন?
বুঝতে পারছি না কতক্ষণ লাগবে। তাড়াতাড়িই ফিরতে চেষ্টা করব। এখন কটা বাজে?
রাত তিনটা। ভোর হবার বেশি বাকি নেই।
ফিহা বাড়ি থেকে বের হলেন। নুহাশকে কিছু বলে গেলেন না।
চল্লিশ বছর পর ফি তার পালক পিতামাতাকে দেখলেন। ঘরে এই দুজন ছাড়া অন্য কেউ নেই। প্রশস্ত একটি বাটে দুজন বসে আছেন। দুজনকেই চূড়ান্ত রকমে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে এঁরা মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মানুষ না কঙ্কাল, জ্বলজ্বলে চোখ ছাড়া এদের যেন কিছুই নেই। ঘর প্রায় অন্ধকার। অস্পষ্টভাবে সব কিছু চোখে আসে।
ফিহা বললেন, আপনারা কেমন আছেন?
দুজনই এক সঙ্গে ফিহার দিকে তাকালেন। বৃদ্ধ হাতের ইশারায় ফিহাকে পাশে বসতে বললেন। ফিহা বললেন, আপনার কি কথা বলার মতত শক্তি আছে?
দুজনই একত্রে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না।
ফিহা বললেন, আমার শৈশব আপনারা আপনাদের ভালবাসায় ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। আপনাদের ছেড়ে চলে এলেও আমি সেই ভালবাসার কথা ভুলি নি। আমার সবচে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটির নামকরণ করা হয়েছে আপনার নামে। মিরান ফাংশান।