বুঝতে পারছি না। তবে আপনার আনন্দ দেখে খানিকটা অনুমান করতে পারছি।
আমি খুব কাছাকাছি আছি। খুব কাছাকাছি। একটি মাত্র জট সেই জট খুলে যাচ্ছে।
স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। পেছনের বাগানে চেয়ার পেতে দি। আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করুন।
সে এখন আমার স্ত্রী নয় পাঠক। আমাকে মারলা লির কাছে যেতে হবে। লাইসেন্স নিয়ে আসতে হবে।
কখন যাবেন?
এখন যাব।
আমি কি স্যার আপনার সঙ্গে আসব?
তুমি আসতে চাচ্ছ কেন?
আপনাকে খুব অস্থির লাগছে। সে জন্যেই আসতে চাচ্ছি।
না আমি অস্থির না। আমি ঠিক আছি। আমি মারলা লির সঙ্গে দেখা করব। তার কাছ থেকে আমি আরো কিছু গ্রন্থও আনতে চাই। তুমি আমার টুপি এনে দাও।
আপনি কি আপনার স্ত্রীকে কিছু বলে যাবেন না?
না। ওর সামনে পড়তে কেন জানি লজ্জাও লাগছে। আচ্ছা পাঠক, মেয়েরা কি উপহার পেলে সবচে খুশি হয় বলত? আমি ফেরার পথে ওর জন্যে কিছু উপহার আনতে চাই। | পাঠক মৃদু স্বরে বলল, ভালবাসার চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে, স্যার!
ভালো বলেছ পাঠক। ভালো বলেছ। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে ভালবাসা। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জান—এই উপহার আমি একমাত্র আমার পালক পিতামাতার কাছ থেকেই পেয়েছি। যারা দুজনই মেন্টালিস্ট।
স্যার, আপনি আমাদের ভালবাসাও পেয়েছেন। তবে আমরা যন্ত্র। আমাদের ভালবাসা মূল্যহীন।
পাঠক, ভালবাসা মূল্যহীন নয়। আজ সম্ভব না, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই ভালবাসাকে অঙ্কে নিয়ে আসা যাবে। অঙ্কের মডেল তৈরি করা হবে। হয়তো আমিই তা করব…
আমি কি আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেব স্যার?
দাও এগিয়ে দাও। গাধা লীম দেখি এখনো গান গাইছে। ব্যাটার গলা এত। সুন্দর তাতো জানতাম না। তাকে বার বার গাধা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।
মারলা লি বললেন
মারলা লি বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। বিয়ের লাইসেন্স এমন জরুরি কিছু নয়।
ফিহা বললেন, আরেকটা জরুরি বিষয় আমার আলোচ্যসূচিতে আছে। আপনার কি সময় হবে?
আমার সময়ের একটু টানাটানি যাচ্ছে। কিন্তু আপনার জন্যে সময় বের করা হবে।
মেন্টালিস্টদের উপর লেখা আরো কিছু বই পড়তে চাচ্ছি।
কেন? যে বইটি দিয়েছেন সেটি অস্পষ্ট।
সব বইই অস্পষ্ট। বিজ্ঞানের বই এগুলি নয়।
মেন্টালিস্টদের জীবনযাপন পদ্ধতি, এদের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যদি কোনো বই থাকে।
শুনুন মহামতি ফিহা, আপনি যেভাবে কথা বলছেন তার থেকে মনে হতে পারে আমরা মানুষ নই। আমরা জন্তু বিশেষ।
শুধু শুধুই আপনি রাগ করছেন।
আমি মোটেই রাগ করছি না। আপনাকে মেন্টালিস্ট সম্পর্কে আর কোনো বই দেয়া যাবে না। আপনি সমাজবিজ্ঞানী নন। আপনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। বাজে কাজে সময় নষ্ট করবেন কেন? সবার কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। আপনি আপনার কাজ করবেন।
ফিহা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, সবার সব কাজ তো আপনারা করিয়ে নিচ্ছেন। আমি জানতে চাচ্ছি আপনাদের কাজটা কি। আপনারা কি করেন? মাটির নিচে শহর বানিয়ে বাস করেন জানি। কিন্তু বেঁচে থাকা ছাড়া আর কি করেন?
আমরা ভাবি।
কি ভাবেন?
পৃথিবীর মঙ্গল নিয়ে ভাবি। মানুষকে পরিচালনা করার সর্বোত্তম পন্থা নিয়ে ভাবি। ভবিষ্যত পৃথিবী কি করে সাজানো হবে তা নিয়ে ভাবি।
ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের স্থান কোথায়?
আমার জানা নেই। শুনুন মহামতি ফিহা, আজ আপনি বিয়ে করেছেন। একটি তরুণী মেয়ে ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে—আজ কেন বাজে তর্ক করে সময় নষ্ট করছেন। তার কাছে যান। যাবার পথে ফুল কিনে নিয়ে যান। ফুলের দোকান এত রাতে নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি খোলাবার ব্যবস্থা। করছি।
কোনো প্রয়োজন দেখছি না।
আপনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মেয়েটির প্রয়োজন আছে। আপনারা মেন্টালিস্ট নন। আপনাদের একেকজনের চিন্তা-ভাবনা একে রকম। ফুল একজনের কাছে অর্থহীন, অন্যজনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ফিহা উঠে দাঁড়ালেন। মারলা লি বললেন, আমি দুঃখিত যে আপনি খানিকটা হলেও মন খারাপ করে যাচ্ছেন। আপনার মন ভালো করার জন্য কিছু কি করতে পারি?
আমি আমার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তা-কি সম্ভব হবে?
না। তা সম্ভব হবে না। তাঁরা যদি ভূগর্ভস্থ শহরে না থাকতেন তাহলে সম্ভব হত। ভূগর্ভস্থ শহর শুধু মেন্টালিস্টদের জন্যে।
সাধারণ মানুষ সেখানে গেলে শহর কি অশুচি হয়ে যাবে?
শুচি-অশুচির প্রশ্ন নয়। এটা হচ্ছে আইন।
আইনের পেছনে যুক্তি থাকে। এই আইনের পেছনের যুক্তিটি কি?
আমরা মানুষ হিসেবে আপনাদের থেকে অনেকখানিই আলাদা। সহাবস্থান আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই এই ব্যবস্থা। আপনারা আমাদের সম্পর্কে যত কম জানবেন ততই মঙ্গল।
আপনারা আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই জানবেন, আর আমরা কিছু জানব না?
আপনাদের সম্পর্কে জানা আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে আপনাদের জানা প্রয়োজন নয়। আলোচনা যথেষ্ট হয়েছে ফিহা। এখন বাড়ি যান। ফুলের দোকান কি খোলাবার ব্যবস্থা করব?
ফিহা জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলেন। রাস্তায় তেমন আলো নেই। ঝড়ে বিদ্যুত ব্যবস্থায় যে সমস্যা হয়েছিল সে সমস্যা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায় নি। ফিহা হাঁটছেন অন্ধকারে। তীব্র হতাশাবোধ তাঁকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ফিরে এসেছে পুরোনো অস্থিরতা।
স্যার।
তিনি চমকে তাকালেন। অন্ধকারে রাস্তার পাশে বিশালদেহী একজন। যুবক।