বিনীত
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী
মাহতাব উদ্দিন চিঠি লিখলেন, টুনটুনি লিখল ডায়েরি। তার একটা ডায়েরি আছে। নীল মলাটের ডায়েরিটার নাম দুঃখ ডায়েরি। তার জীবনে দুঃখ বা কষ্টের কিছু ঘটলে সে এই ডায়েরিতে তা লিখে রাখে। লাল মলাটের ডায়েরির নাম আনন্দ ডায়েরি। আনন্দময় ঘটনাগুলি এই ডায়েরিতে লেখে। তিন নম্বর ডায়েরিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি থাকে। এই ডায়েরিতে সে লিখল—
আলেকজান্ডার বেলায়েভের একটি উপন্যাসের নাম উভচর মানুষ। আমি যে কয়টি ভালো উপন্যাস পড়েছি এটা তার একটা। বইটা কিছুদিন আগেও আমার কাছে ছিল। এখন হারিয়ে গেছে। বইটির নায়ক উভচর মানুষ। সে স্থলেও থাকতে পারে আবার পানিতেও থাকতে পারে। প্রথমবার বইটি পড়ে বইয়ের নায়কের দুঃখে খুব কেঁদেছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম যেন আল্লাহ আমাকে উভচর মানুষ বানিয়ে দেন। খুবই মজার ব্যাপার, আমাদের বাড়িতে এখন একজন উভচর মানুষ বাস করে। এই মানুষটার নাম খলিলুল্লাহ। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে থাকতে পারে। মানুষটা সম্পর্কে আমরা কেউ কিছু জানি না। তবে খুব শিগগিরই আমি জেনে ফেলব। আমি বিশটি প্রশ্ন তার জন্যে তৈরি করছি। প্রশ্নগুলো তৈরি হয়ে গেলেই আমি তাঁকে প্রশ্ন করব এবং উত্তরগুলিও লিখে ফেলব। লোকটি যদি সত্যি উভচর হয় তাহলে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে হৈচৈ পড়ে যাবে। তবে আমার বাবার ধারণা লোকটা কোনো একটা কৌশল করে পানির নিচে থাকে। জাদুর কৌশলের মতো কোনো কৌশল। বাবার ধারণাও ঠিক হতে পারে। বাবা খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ।
হাবীবুর রহমান সাহেব চিঠির জবাব পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন–
জনাব মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী,
আসসালাম। লোক মারফত আপনার পত্ৰ পাইয়াছি। আপনার কুশল জানিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি। আমার নিজের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যাইতেছে না। বৃদ্ধ বয়সের নানান আধি ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিছুদিন যাবৎ প্রস্রাবে সমস্যা হইতেছে। প্রস্রাবের সময় খুব জ্বালাপোড়া করে। স্থানীয় ডাক্তার চিকিৎসা করিতেছেন। তেমন ফল পাইতেছি না। তিনি ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখাইবার জন্য পরামর্শ দিতেছেন। ঢাকায় আমার চেনা-জানা কম। এখন আপনি একমাত্র ভরসা। আপনার মতো মানুষের সহায়তা পাইলে আমার মতো নাদানের জন্য অত্যন্ত উপকার হয়। হোটেলে থাকিয়া চিকিৎসার ব্যয় সঙ্কুলান আমার জন্যে অসম্ভব ব্যাপার। বিষয়টি আপনার গোচরে আনিলাম। এখন আপনার মর্জি।
খলিলুল্লার বিষয়ে আসি। আপনি লিখিয়াছেন নষ্ট কল ফইড় করিতে পারি এই বাক্যটির অর্থ আপনি উদ্ধার করতে পারিতেছেন না। ফইড় নেত্রকোনার আঞ্চলিক শব্দ। এর অর্থ ঠিক করা। খলিলুল্লাহ যন্ত্রপাতি ঠিক করতে পারে। যদিও কলকবজার বিষয়ে সে কিছুই জানে না। ট্রানজিস্টার রেডিওর সমস্যা সে ধরিতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করতে পারে। আমার বাসায় একটি ১৪ ইঞ্চি টিভি দীর্ঘদিন অকেজো পড়িয়া ছিল। নেত্রকোনা শহরে রেডিও-টিভি সারাই-এর দোকানে পাঠাইয়াও ফয়দা হয় নাই। সেই টিভিও খলিলুল্লাহ ঠিক করিয়া দিয়াছে। এই কাজটি সে কীভাবে করে তা এক বিরাট রহস্য। আল্লাহপাকের জগৎ রহস্যময়। তিনি একেকজন মানুষকে একেক ক্ষমতা দিয়া পঠাইয়াছেন। খলিলুল্লাহর যন্ত্রপাতি ঠিক করিবার এই আশ্চর্য ক্ষমতা আপনি নিজে পরীক্ষা করিলে খুবই মজা পাইবেন। খলিলুল্লাহ বিষয়ে এরচে বেশি কিছু আমি জানি না। অবশ্য সেইভাবে খোঁজ-খবরও নেই নাই। যদি বলেন অনুসন্ধান করিব। অনুসন্ধানে ফল হইবে কিনা জানি না। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি স্কুলের পুকুরে দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবিয়া থাকিবার খেলা দেখাইয়াও সে অনেকের প্রশংসা কুড়াইয়াছে।
পত্র এইখানে শেষ করিতেছি। আপনি আমার জন্যে দোয়া করিবেন। দয়াময়ের নিকট আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।
আরজগুজার
হাবীবুর রহমান বিএ বিটি
অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার
নীলগঞ্জ হাইস্কুল
পুনশ্চ : আমার বড় বৌমা মুসাম্মাদ দিলশাদ খানম খলিলুল্লাহ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানে। সে তার শাশুড়ি আম্মাকে বলিয়াছে যে খলিলুল্লাহ সম্পর্কে সে খুব আশ্চর্যজনক কিছু কথা জানে। সে সব কথা প্রকাশ করা সমীচীন নহে।
বড় বৌমা সন্তান-সম্ভবা। এখন বাপের বাড়িতে আছে। আপনি আগ্রহী হইলে বড় বৌমার নিকট তথ্য সংগ্রহ করিয়া আপনাকে পাঠাইতে পারি।
টুনটুনি দশটি প্রশ্ন এবং তার উত্তর জোগাড় করেছে। কিছু কিছু উত্তরের সঙ্গে তার মন্তব্যও আছে। টুনটুনির প্রশ্নোত্তর পর্ব এই রকম
১ম প্রশ্ন : আপনার নাম কী?
উত্তর: আমার নাম খলিলুল্লাহ। লোকে আমারে ডাকে
খলিল। কেউ কেউ ডাকে খইল্যা।
মন্তব্য: এই প্রশ্নটি করা ঠিক হয় নি। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। শুধু জানি না যে, তাকে কেউ কেউ খইল্যা ডাকে। খইল্যা নিশ্চয়ই আপমানসূচক ডাক।
২য় প্রশ্ন : আপনার দেশের বাড়ি অর্থাৎ গ্রামের বাড়ি কোথায়?
উত্তর: জানি না তো মা। আমি ছোট থাইক্যা ভাইস্যা বেড়াইন্যার দলে।
মন্তব্য : লোকটার কথা থেকে মনে হচ্ছে কিছু লোকজন আছে যারা ভেসে বেড়ায়। যাযাবররা ভেসে বেড়ায়। তারা কোথাও বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে পারে না। বেদেরাও ভেসে বেড়ায়। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে যাযাবর হতে ইচ্ছা করে।
৩য় প্রশ্ন : আপনি কি লেখাপড়া জানেন?
উত্তর: না।
৪র্থ প্রশ্ন : স্বরে অ, স্বরে আ, ক, খ, জানেন না?