মাহতাব সাহেব ঘড়ি ধরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সুইমিংপুলের পাশে বসে রইলেন। এক পলকের জন্যেও খলিলুল্লাহর মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরালেন না। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তিনি ছটা সিগারেট খেয়ে ফেললেন। এক সময় হাত ইশারা করে খলিলুল্লাহকে পানি থেকে উঠতে বললেন। সে খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে এলো।
মাহতাব সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি নিচে যাও। আজ আর তোমার দেশের বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই।
খলিলুল্লাহ বলল, জে আইচ্ছা!
মাহতাব উদ্দিন টুনটুনির দিকে তাকিয়ে আছেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। টুনটুনি কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। সে বাবার কাছ থেকে শুনতে চায়। মাহতাব সাহেব সপ্তম সিগারেটটা ধরালেন। টুনটুনি বলল, তুমি অনেকগুলি সিগারেট খেয়ে ফেলে।
মাহতাব উদ্দিন বললেন, হুঁ।
টুনটুনি বলল, সুইমিংপুলে নামবে?
মাহতাব উদ্দিন বললেন, না।
আজ খুব গরম পড়েছে তাই না বাবা?
হুঁ।
টুনটুনি বলল, সবচে গরম কোন মাসে পড়ে বাবা? চৈত্র মাসে না ভাদ্র মাসে?
জানি না।
পিতা-কন্যা এমনভাবে কথা বলছে যেন কিছুক্ষণ আগে সুইমিংপুলে কোনো ঘটনা ঘটেনি। যেন দুজনই ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায়। টুনটুনি বলল, আবহাওয়াটা কেমন যেন ভারি হয়ে আছে। বাবা, একটা জোকস বলে।
মাহতাব উদ্দিন বললেন, একটা অফিসে টেলিফোন এসেছে। অফিসের বসকে টেলিফোনে চাইছে। বসের সেক্রেটারি বলল, আপনি কে বলছেন পরিচয় দিন, স্যার যার তার সঙ্গে কথা বলেন না। টেলিফোনের ওপাশ থেকে ভারি গলা শোনা গেল, আমি অনেক উপরের লোক। তোমার বসকে দাও।
আপনি কি কোনো মন্ত্রী?
না, আমি তারও উপরে?
আপনি কি প্রধানমন্ত্রী?
আরে না, আমি তারও উপরে।
বলেন কী? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন না তো?
তারও উপরে?
বলেন কী? আপনি কি আল্লাহ?
আরে না তারও উপরে।
আল্লাহর উপরে তো কেউ না।
আমি সেই কেউ না।
গল্প শুনে টুনটুনি খিলিখিল করে হাসছে। মাহতাব উদ্দিন বললেন, তোর হাতে পিংপিং বল না? দেখি পিংপং বলের খেলাটা আরেকবার দেখা তো।
টুনটুনি দেখাল। একটা বল দুটা হয়ে যাচ্ছে। দুটা বল একটা হচ্ছে।
তোর হাত তো খুব চালু হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে একেবারে প্রফেশনাল। নতুন কী জাদু শিখলি?
টুনটুনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, বাবা আমরা দুজনাই ভান করছি যেন এখানে কিছুই হয়নি। কোনো ঘটনা ঘটে নি। সব স্বাভাবিক। কিন্তু দুজনই খলিলুল্লাহর ঘটনা দেখে ধাক্কার মতো খেয়েছি। এই বিষয়ে কিছু বলে।
চিন্তা করছি।
চিন্তা করে কিছু পাচ্ছ না?
একটা জিনিস পাচ্ছি—এরকম কিছু ঘটতে পারে না। মানুষ স্থলচর প্রাণী। উভচর প্রাণী না। বেঁচে থাকার জন্যে মানুষকে প্রচুর অক্সিজেন নিতে হয়। এই অক্সিজেন সে বাতাস থেকে নেয়। পানিতে যে সব প্রাণী বাস করে তাদেরও অক্সিজেন লাগে। তারা সেই অক্সিজেন পানি থেকে নেয়। মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই এক ঘণ্টা পানিতে বসে থাকা সম্ভব না।
খলিলুল্লাহ কীভাবে থাকল।
সে কোনো একটা কৌশল করেছে। সে কৌশল আমরা ধরতে পারছি না। ডুবুরিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির নিচে থাকে। তারাও কৌশল ব্যবহার করে। অক্সিজেন মাস্ক পরে থাকে। খলিলুল্লাহ যে কৌশল ব্যবহার করেছে সেটা অপ্রকাশ্য কৌশল। আমরা তা বুঝতে না পেরে হকচকিয়ে গেছি। কোনো কিছু দেখে হকচকিয়ে গেলেই যে জিনিসটা সত্যি তা কিন্তু না। আমরা যখন স্টেজে ম্যাজিক-শো দেখতে যাই তখন কী দেখি? তখন দেখি জাদুকর জুয়েল আইচ ইলেকট্রিক করাত দিয়ে একটা মেয়েকে কেটে দুভাগ করছেন। ঘটনাটা সবার চোখের উপর ঘটলেও ঘটনা সত্যি না।
তোমার ধারণা খলিলুল্লাহ যা দেখিয়েছে তা সত্যি না?
না।
তাহলে সে এটা কীভাবে করেছে?
জানি না কীভাবে করেছে। আমি চিন্তা করছি।
উনাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?
জুয়েল আইচকে যদি জিজ্ঞেস করি, আপনি কীভাবে করাত দিয়ে কেটে একটা মেয়েকে দুভাগ করেন, তিনি কী উত্তর দেবেন? উত্তর দেবেন না। খলিলুল্লাহ উত্তর দেবে না। আমি অবশ্যই খলিলুল্লাহকে প্রশ্ন করব। তবে আঁটঘাট বেঁধে প্রশ্ন করব। তখন উত্তর দেয়া ছাড়া তার অন্য উপায় থাকবে না।
আঁটঘাট কীভাবে বাঁধবে?
জানি না কীভাবে বাঁধব। চিন্তা করছি।
টুনটুনি হঠাৎ হেসে ফেলল। মাহতাব সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছিস কেন?
তুমি খুবই ঘাবড়ে গেছ বাবা। তোমার চোখমুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। তোমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।
মাহতাব উদ্দিন অষ্টম সিগারেটটা ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগলেন। সেদিন বিকেলেই তিনি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাবীবুর রহমান সাহেবের কাছে চিঠি দিয়ে লোক পাঠালেন। তিনি লিখলেন–
জনাব হাবীবুর রহমান
শ্ৰদ্ধাভাজনেষু,
আপনার চিঠি পেয়েছি। যার মারফত চিঠি পাঠিয়েছেন সে আমার বাড়িতেই আছে। তার কিছু ক্ষমতার কথা আপনি বলেছেন। কী ধরনের ক্ষমতা তা ব্যাখ্যা করেন নি। দয়া করে বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে লিখে জানাবেন, তাহলে আমার অনুসন্ধান করতে সুবিধা হবে। লোকটির পূর্ণ ইতিহাসও জানাতে চেষ্টা করবেন। ইতিহাস বলতে আমি তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আচার ব্যবহারের কথা বলছি। আমি তাকে তার বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি—সে বলেছে সে কলের জিনিস ফইড় করতে পারে। ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয় নি। আপনি এ বিষয়ে যা জানেন তা আমাকে জানাবেন। খলিলুল্লাহর দেশের বাড়ি কোথায়, তার আত্মীয়স্বজন কে আছে তাও জানাবেন। আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা আছে। সময় সুযোগমতো ইনশাল্লাহ সাক্ষাৎ হবে। আপনি ভালো থাকবেন।