টুনটুনি বলল, আপনার নাম খলিলুল্লাহ?
খলিলুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টি সুইমিংপুলের পানির দিকে। মানুষের বাড়ির ছাদেও যে দিঘি থাকতে পারে এই ধারণা সম্ভবত তার নেই। খলিলুল্লাহর চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা। সে এক মুহূর্তের জন্যেও সুইমিংপুলের পানি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারছে না।
টুনটুনি কথা বলার জন্যে খলিলুল্লাহকে ছাদে নিয়ে এসেছে। বাবার সামনে কথা বলতে সে হয়তো অস্বস্তি বোধ করবে এই ভেবে মাহতাব সাহেবকে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। টুনটুনি বসেছে সুইমিংপুলের উঁচু পাড়ে। খলিলুল্লাহ তার সামনেই দাঁড়ানো।
বাবা বলছিল আপনার না-কি কী ক্ষমতা আছে। কী ক্ষমতা? আমাকে বলুন। আমাকে বলতে কোনো সমস্যা নেই। আমি ছোট মানুষ তো। ছোট মানুষকে যে-কোনো কিছু বলা যায়।
খলিলুল্লাহ টুনটুনির কথার উত্তরে কিছু বলল না। আগের মতোই পানির দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনটুনি বলল, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। রিলাক্সড হয়ে বসুন।
খলিলুল্লাহ বসল না। টুনটুনি বলল, আমারও কিন্তু ক্ষমতা আছে। আমি কী করতে পারি জানেন? আমি একটা পিংপং বলকে দুটা বানাতে পারি। আবার একটা বল শূন্যে ভ্যানিস করে দিতে পারি। দেখবেন?
খলিলুল্লাহ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। টুনটুনি ব্যাগে করে ম্যাজিক দেখানোর জিনিস নিয়ে এসেছিল। একটা পিংপং বল দুটা করার ম্যাজিক খুব সহজ ম্যাজিক। তবে যারা ম্যাজিকের কৌশল জানে না তারা খুবই অবাক হয়। টুনটুনি আগ্রহ নিয়ে ম্যাজিকটা দেখাল। একটা পিংপং বল দুটা হয়ে যাচ্ছে। আবার একটা বল শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। খলিলুল্লাহ অবাক হয়ে ম্যাজিকটা দেখল। টুনটুনি বলল, আপনি কি এরকম পারেন?
জ্বে না।
তাহলে কী পারেন?
কলের জিনিস ফইড় করতে পারি।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। কলের জিনিস কী? আর ফইডইবা কী?
একটা নষ্ট কলের জিনিস দেন, আমি ফইড় করব।
আমি তো আপনার কথাই বুঝতে পারছি না। কলের জিনিস ফইড় করা ছাড়া আর কী পারেন?
পানির খেলা পারি।
পানির খেলাটা কী?
পানির মইধ্যে থাকতে পারি।
পানির মধ্যে তো সবাই থাকতে পারে। আমি একবার সন্ধ্যাবেলায়। সুইমিংপুলে নেমেছিলাম, রাত এগারোটায় উঠেছি। তারপর আমার অবশ্যি জ্বর এসে গিয়েছিল।
খলিলুল্লাহ নিচু গলায় বলল, পানির মইধ্যে নাইম্যা আমার খেলাটা দেখাই? দেখাইলে বুঝবেন। না দেখাইলে বুঝবেন না।
সুইমিংপুলে নামতে চান?
খলিলুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। টুনটুনি বলল, আপনি সুইমিংপুলে নামলে বাবা খুব রাগ করবেন।
তাইলে থাউক।
টুনটুনি বলল, পানির খেলাটা কী রকম? একরোবেটিক কিছু?
খলিলুল্লাহ বলল, না দেখলে বুঝবেন না। দেখলে মজা পাইবেন। সবেই মজা পায়।
আপনার এই খেলা দেখলে সবাই মজা পায়? জ্বে পায়।
টুনটুনির খুবই ইচ্ছা করছে পানির খেলাটা দেখতে। খেলাটা সত্যি সত্যি যদি খুব মজার হয় তাহলে সেও শিখে নিতে পারবে। এই খেলা দেখিয়ে অন্যদের অবাক করে দিতে পারবে। লোকটা যদি সাবান দিয়ে গোসল করে তারপর পানিতে নামে তাহলে কি বাবা খুব বেশি রাগ করবেন?
এই খেলা দেখাতে আপনার কতক্ষণ লাগবে?
আপনে যতক্ষণ বলবেন ততক্ষণ দেখাব।
আচ্ছা বেশ, দেখান আপনার খেলা। বেশিক্ষণ দেখাতে হবে না, অল্প কিছুক্ষণ দেখালেই হবে। পানিতে নামার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে-গায়ে সাবান মেখে খুব ভালো করে গোসল করতে হবে। ডান দিকের হলুদ দরজাওয়ালা ঘরটায় শাওয়ার আছে, সাবান আছে। ভালো করে গোসল করে নিন। শাওয়ার কী করে ছাড়তে হয় জানেন?
জ্বে না।
আসুন আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। আরেকটা কথা, আপনি পানিতে নামার সময় বাবা যদি হঠাৎ ছাদে এসে দেখে ফেলেন তাহলে তিনি খুবই রাগারাগি করবেন। কাজেই আপনি আপনার খেলাটা দ্রুত দেখিয়ে উঠে পড়বেন। ঠিক আছে?
খলিলুল্লাহ ঘাড় কাত করে হাসল। এই প্রথম মনে হলো বাচ্চা মেয়েটার কথাবার্তায় সে খুব মজা পাচ্ছে।
টুনটুনি ভেবেছিল পানির খেলাটা খুব জটিল কিছু হবে। বাস্তবে দেখা গেল ব্যাপারটা জটিল কিছু না। পানিতে হাত-পা ছড়িয়ে ডুবে থাকা। টুনটুনিদের সুইমিংপুলে পানি বেশি নেই। সবচে গভীর জায়গাটা মাত্র পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। অগভীর জায়গাটা সাড়ে তিন ফুট। খলিলুল্লাহ নামের লোকটা অগভীর জায়গায় হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। পরিষ্কার পানিতে তার চোখমুখ দেখা যাচ্ছে। টুনটুনি প্রথমে ভাবল যে সে পানির নিচে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, হাসছে—এটাই বোধহয় খেলা। খেলাটা যে এরচেয়েও অনেক বেশি জটিল এটা বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগল। যখন সে বুঝতে পারল তখন বুকে ধাক্কার মতো লাগল। মানুষ দুএক মিনিটের বেশি পানির নিচে থাকতে পারে না। খলিলুল্লাহ পানির নিচে অনেকক্ষণ হলো আছে। সেই অনেকক্ষণ মানে কতক্ষণ। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট না তার চেয়েও বেশি? এটা কী করে সম্ভব? এটা কি ম্যাজিকের কোনো কৌশল?
সিড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সুইমিং কস্টিউম পরে মাহতাব সাহেব আসছেন। তিনি টুনটুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, খলিলুল্লাহর সঙ্গে তোর ইন্টার কি শেষ হয়েছে?
টুনটুনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
মাহতাব সাহেব বললেন, লোকটার ক্ষমতার কোনো নমুনা দেখেছিস। ফইড় খেলা দেখিয়েছে?
টুনটুনি কিছু বলল না।
মাহতাব সাহেব বললেন, সে গেছে কোথায়?
টুনটুনি আঙুল দিয়ে সুইমিংপুলের পানি দেখিয়ে চাপা গলায় বলল, বাবা, লোকটা খুব কম করে হলেও দশ মিনিট হলো পানিতে ডুবে আছে।