বাবা-মারা চান তাদের ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো হোক। টুনটুনি তাদের সেকশানের ফার্স্ট গার্ল। এসএসসি পরীক্ষায় এই মেয়ে যে স্ট্যান্ড করবে এ বিষয়ে শিক্ষকরা একশ ভাগ নিশ্চিত।
বাবা-মার স্বপ্ন তাদের ছেলেমেয়ে শুধু পড়াশোনা না, অন্য বিষয়েও ভালো করবে। গান-বক্তৃতা-নাটক-লেখালেখি। টুনটুনি চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। আঠারো বছর হবার আগে রেডিও বা টেলিভিশনে এনলিস্টেড হবার নিয়ম নেই বলে সে এনলিস্টেড না। টেলিভিশনের নতুন কুঁড়িতে সে রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছে।
গান ছাড়াও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় টুনটুনি একটা জিনিস শিখেছে, তার নাম ম্যাজিক। তার জন্মদিনে সে একটা বই পেয়েছিল, বইটার নাম 1001 Tricks। বই পড়ে-পড়ে হাত সাফাইয়ের এই বিদ্যা সে নিখুঁত আয়ত্ত করেছে। একটা আস্ত পেনসিল নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া, কয়েন শূন্যে ভ্যানিস করে দিয়ে অন্যের কান থেকে বের করা, দড়ি কেটে জোড়া লাগানো এই ম্যাজিকগুলি সে চমৎকার করে দেখাতে পারে। তাদের আমেরিকান ক্লাস টিচার (মিস এলেন) একবার টুনটুনির নাকের ফুটো দিয়ে পেনসিল ঢোকানোর ম্যাজিক দেখে Stop it! বলে এমনভাবে কেঁপে উঠলেন যে চেয়ার নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন। বহুগুণে গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও টুনটুনির কোনো বন্ধু নেই। তার ক্লাসের মেয়েরা তার সঙ্গে গল্প বলার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করে না। তাদের জন্মদিনে সবার দাওয়াত হয়—টুনটুনির কথা সবাই ভুলে যায়। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দুজন দুজন করে গ্রুপ। দেখা গেল টুনটুনিকে নিয়ে কেউ গ্রুপ করতে চাচ্ছে না। ফিজিক্স টিচার মিসেস রিতা বললেন জেসমিন (টুনটুনির ভালো নাম জেসমিন চৌধুরী) তোমার সঙ্গে কেউ আসতে চাচ্ছে না কেন? টুনটুনি ধরা গলায় বলল, কিছু হবে না ম্যাডাম।
কিছু হবে না মানে? তুমি একা কাজ করবে?
টুনটুনি বলল, আমাদের ক্লাসে odd number student। একজনকে তো একা থাকতেই হবে।
টুনটুনির খুবই মন খারাপ হলো। মন খারাপ হলে সে মন ভালো করার জন্যে কিছু কাজ করে। যেমন, মনে-মনে ইকরি মিকরি ছড়া বানায়। এই কাজটা সে খুব ছোটবেলায় করত, তখন দ্রুত মন ভালো হয়ে যেত। এখন আর এত দ্রুত মন ভালো হয় না, তবু হয়।
আজ এই মুহূর্তে টুনটুনির মন খুবই খারাপ। তার দুবান্ধবীর একজন। (তিতলী) বলেছে পিয়াল যদি যায় আমি অবশ্যই যাব। পিয়ালকে তার বাসা থেকে তুলে আমাকে তুলে নিয়ে যেও। পিয়াল বলেছে—আমি যাব না। আমার পেটব্যথা। আমি বিছানা থেকেই নামব না।
পিয়ালের কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ কথা বলার সময় পিয়াল হাসছিল। প্রচণ্ড পেটব্যথা নিয়ে কেউ খিলখিল করে হাসতে পারে? টুনটুনির ধারণা তিতলী এবং পিয়াল দুজনে যুক্তি করে কাজটা করেছে। শুরুতেই তারা না বললেই পারত।
টুনটুনি মন খারাপ ভাবটা কাটাবার জন্যে ইকড়ি মিকড়ি ছড়া বানাচ্ছে।
ইকড়ি মিকড়ি ইকড়ি মিকড়ি।
এসেছে তিলী ফিকড়ি ফিকড়ি।
পিয়ালও এসেছে, পা তুলে বসেছে।
ব্যথা তার উঠেছে চিকড়ি চিকড়ি।
ইকড়ি মিকড়ি ইকড়ি মিকড়ি।
টুনটুনির দরজায় টোকা পড়ল। টুনটুনি বলল, কে?
মাহতাব উদ্দিন বললেন, দরজা বন্ধ করে বসে আছিস কেন রে মা? যাবি না?
টুনটুনি বলল, প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয়েছে বাবা।
ক্যানসেল হলো কেন? বান্ধবীরা আসবে না?
না।
তারা না এলে না আসবে, আমি আর তুই আমরা দুজনে মিলে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করব।
আমার আজ আর পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে না।
দরজা খোল তো।
টুনটুনি দরজা খুলল। মাহতাব উদ্দিন মেয়ের বিষন্ন মুখ দেখলেন। তাঁর মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। মা-মরা এই মেয়েটির মন খারাপ হলে তাঁর নিজের মাথা এলোমেলো লাগে।
টুনটুনি।
বলো।
চৈত্রের দুপুরে পিতা-কন্যা পানিতে ভাসছে—এর আনন্দই অন্যরকম। মন খারাপ করে বসে থাকিস না, সুইমিং কস্টিউম বের কর।
টুনটুনি বলল, ঠিক আছে বের করছি।
মাহতাব সাহেব মেয়ের খাটে বসতে বসতে বললেন, তুই শুনে খুশি হবি যে আজ এখন পর্যন্ত আমি কারো সঙ্গে রাগারাগি করিনি। খলিলুল্লাহর সঙ্গে হাসি-হাসি মুখে কথা বলেছি।
খলিলুল্লাহ কে?
গ্রাম থেকে একজন এসেছে। নেত্রকোনা থেকে সরাসরি হেঁটে ঢাকায় চলে এসেছে।
কী জন্যে এসেছে? চাকরির জন্যে না সাহায্য?
কী জন্যে এসেছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। হেডমাস্টার সাহেব চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন তার না-কি বিশেষ কিছু ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা পরীক্ষা।
কী ক্ষমতা?
জানি না তোমা কী ক্ষমতা। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেও বলতে পারে না। সে বলল ফইড করতে পারে। ফই কী জিনিস কে বলবে।
টুনটুনি বলল, বাবা আমি উনার সঙ্গে কথা বলব।
মাহতাব সাহেব বললেন, কোনো দরকার নেই। যন্ত্রণা বাড়াবি না।
টুনটুনি বলল, দরকার আছে। তুমি তাকে আমার ঘরে পাঠাও।
সে হয়তো এতক্ষণে চলে গেছে।
চলে গেলে তাকে আবার ব্যবস্থা করো। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। প্লিজ। তার সঙ্গে কথা বলার পর তোমাকে নিয়ে পানিতে নামব।
টুনটুনির মুখ থেকে বিষাদ ভাবটা চলে গেছে। আগ্রহ এবং উত্তেজনায় টুনটুনির চোখ চকচক করছে। মাহতাব উদ্দিনের মনে হলো—অতি নির্বোধ একজন মানুষের কল্যাণে কিছুক্ষণের জন্যেও যদি তাঁর মেয়েটার মন ভালো হয় তাতে ক্ষতি কিছু নেই। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। খলিলুল্লাহ চলে গিয়ে থাকলে তাকে ফেরত আনার জন্যে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত লোক পাঠাতে হবে।