বাড়িতে যে যাবে যাবার ভাড়া আছে?
জ্বে না।
যাবে কীভাবে?
হাঁটা পথে।
হাঁটা পথে মানে কি হেঁটে হেঁটে?
জ্বে।
হেঁটে হেঁটে চলে যেতে পারবে?
জ্বে। হাঁইটা আসছি। হাঁইটা যাব।
নেত্রকোনা থেকে ঢাকা হেঁটে এসেছ?
জ্বে।
কত ঘণ্টা লেগেছে?
ঘণ্টার হিসাব করি নাই। সকালে রওনা দিলে পরের দিন দুপুরের মইধ্যে যাওয়া যায়।
সারাদিন সারারাত হাঁটতে হবে?
জ্বে।
শোন খলিলুল্লাহ, তোমার হেঁটে যাবার কোনো দরকার নেই। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে। তারপরে আমার কেয়ারটেকার আছে, তার কাছ থেকে বাস-ভাড়া নিয়ে চলে যাও। কেয়ারটেকারের নাম বারেক মিয়া।
জ্বে আইচ্ছা।
দেশের বাড়িতে তোমার আছে কে?
কেউ নাই। আমি একলা।
বাড়িঘর আছে?
জ্বে না।
বাড়িঘর নাই ঘুমাও কোথায়?
এর-তার বাড়ির উঠানে শুইয়া থাকি। মাঝে মইদ্যে মসজিদে ঘুমাই।
ঠিক আছে এখন যাও। দুপুরে চলে যাবে।
জ্বে আইচ্ছা।
খলিলুল্লাহ পা ছুঁয়ে সালাম করতে এলো। মাহতাব সাহেব বললেন, সালাম করতে হবে না। খলিলুল্লাহ সালাম না করে উঠে দাঁড়াল। মাহতাব সাহেব বললেন, আমার বাড়িতে চাকরির গাছ নেই যে গাছ ভর্তি চাকরি ফল ফলে আছে। তোমরা কেউ আসবে আর আমি বঁাশ দিয়ে চাকরি ফল পেড়ে তোমাদের হাতে একটা করে ধরিয়ে দেব। কাঁচা পাকা ফলের মতো, কোনোটা কাঁচা চাকরি, কোনোটা পাকা চাকরি। বুঝতে পেরেছ কী বলছি?
খলিলুল্লাহ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমি চাকরির জন্যে আসি নাই।
মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, চাকরির জন্যে আসোনি তাহলে কীসের জন্যে এসেছ? ঢাকা শহর দেখতে? চিড়িয়াখানা, এয়ারপোর্ট দেখে বেড়াবে? না-কি চিকিৎসার কোনো ব্যাপার। পেটেব্যথার চিকিৎসা?
খলিলুল্লাহ সার্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল। মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কী?
হেডমাস্টার সাব একটা পত্র দিয়েছেন।
মাহতাব সাহেব ভুরু কুঁচকালেন। এই আরেক সমস্যা, গ্রাম থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চিঠি দিয়ে পাঠাচ্ছে—অমুকের চিকিৎসা করাতে হবে। তমুকের মেয়ের বিবাহ, সাহায্য লাগবে। হেডমাস্টার সাহেব জাতীয় মানুষরা চিঠি দিয়েই খালাস। মাহতাব চিঠিতে চোখ বুলালেন—
জনাব মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী,
আসসালাম। আমি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার হাবীবুর রহমান। আপনার সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল, সম্ভবত আপনার ইয়াদ আছে। আপনার মতো বিশিষ্ট মানুষ আমার মতো নাদানকে মনে রাখবেন ইহা আমি আশা করি না। যা হউক, পত্ৰবাহক খলিলুল্লাহকে আপনার নিকট পাঠাইলাম। সে বছর তিনেক আগে মাটি কাটা শ্ৰমিকদলের সহিত আমাদের অঞ্চলে উপস্থিত হয়। এলজিআরডির রাস্তার কাজ সম্পন্ন হইবার পর সমস্ত শ্রমিকদল বিদায় হইয়া গেলেও খলিলুল্লাহ থাকিয়া যায়। সারাদিন কাজ-কাম করিয়া সে গ্রামবাসী কারো একজনের উঠানে শুইয়া ঘুমাইত। সে কিছুদিন আমার বাড়িতেও ছিল। এই সময় তাহার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা আমার চোখে পড়ে।
অল্প কথায় বলিতে গেলে আমি বিস্ময়াভিভূত। আপনারা শহর অঞ্চলে বাস করেন। জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনারা এইসব জিনিসের মূল্য বুঝিবেন বিধায় তাহাকে আপনার নিকট পাঠাইলাম। যদি অপরাধ হয় নিজগুণে ক্ষমা করিবেন। পত্রের ভুল-ত্ৰুটি মার্জনীয়।
আরজগুজার
হাবীবুর রহমান
মাহতাব সাহেব খলিলুল্লার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই চিঠিতে কী লেখা তুমি জানো?
জ্বে না।
পড়তে জানো না?
জ্বে না।
চিঠিতে লেখা তোমার কী সব ক্ষমতা না-কি আছে। কী ক্ষমতা?
আমি জানি না।
মাটি কাটার বাইরে আর কিছু করতে পারো?
খলিলুল্লাহ বলল, কলের জিনিস ফইড় করতে পারি।
কলের জিনিস ফইড় করতে পারো মানে কী?
খলিলুল্লাহ বিভ্রান্ত হয়ে গেল। মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ। এখন সামনে থেকে যাও।
খলিলুল্লাহ বলল, জ্বে আইচ্ছা। স্যারের চিঠিটা কি ফিরত নিয়া যাব?
চিঠি ফেরত নিতে হবে না। চিঠি থাক। তুমি ফেরত যাও।
জ্বে আইচ্ছা।
মাহতাব সাহেবের মনে হলো, খলিলুল্লাহ বেশ আনন্দের সঙ্গেই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তার চেহারা এবং কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে সে অতি নির্বোধ একজন মানুষ। অতি নির্বোধদের কর্মকাণ্ডে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকে গ্রামের মানুষদের কাছে নির্বোধের অস্বাভাবিকতাকে মনে হয় বিরাট কিছু। খলিলুল্লাহর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কুমিল্লা শহরে এরকম এক অর্ধউন্মাদ নির্বোধ নিয়ে কম নাচানাচি হয়নি। তার বিরাট ভক্ত দল জুটে গেল। সবার মুখে পিরপাগলা, পির-পাগলা। তিনি নিজেও একদিন পির-পাগলাকে দেখতে গেলেন, পির পাগলা ফোৎ করে না থেকে সর্দি ঝেড়ে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, চেটে খেয়ে ফেল। তিনি হতভম্ব। পির-পাগলাকে ঘিরে যারা বসেছিল তাদের একজন বলল, ভাইসাব চোখ বন্ধ করে টান দিয়ে খেয়ে ফেলেন। আপনার গতি হয়ে যাবে।
মাহতাব সাহেব ঘড়ি দেখলেন। টুনটুনিকে নিয়ে বের হবার কথা। সে এখনো তার ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সমস্যা হয়েছে। টুনটুনি বলে গিয়েছিল, দুই মিনিটের মধ্যে নামছি বাবা। দু মিনিটের জায়গায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। বান্ধবীদের নিয়ে সুইমিংপুলে ঝাঁপাঝাঁপির প্রোগ্রাম হয়তো বাতিল হয়ে গেছে। টুনটুনির বেশির ভাগ প্রোগ্রাম শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যায়। সে তখন তার ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা বসে থাকে।
টুনটুনি নামটা শুনলে মনে হয় সে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে, বয়স চার কিংবা পাঁচ। আসলে টুনটুনির বয়স এই নভেম্বরে তেরো হবে। সে হেলিক্রস স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। সায়েন্স গ্রুপ। পৃথিবীর সমস্ত বাবা-মা যে আদর্শ সন্তানের কথা ভাবেন টুনটুনি সেরকম একজন। টুনটুনির স্বভাব-চরিত্রে কোনো ক্রটি আছে কিনা এটা ধরার জন্যে যদি কোনো তদন্ত-কমিশন বসে এবং হাইকোর্টের কোনো বিচারপতি যদি তদন্ত-কমিশনের চেয়ারম্যান হন তাহলেও কোনো ত্রুটি ধরা পড়বে না।