মাহতাব উদ্দিন খলিলুল্লাহর ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। জানালায় টোকা দিয়ে বললেন, কেমন আছ খলিলুল্লাহ?
খলিলুল্লাহ মুখ তুলল না। কাজ করতে করতেই বলল, ভালো আছি।
যন্ত্র তৈরি হচ্ছে?
জ্বি।
এই যন্ত্রে অতীতের কথা শোনা যাবে?
জ্বি। শুধু কথা শোনা যাবে না। ছবিও দেখা যাবে।
বলো কী! ছবিও দেখা যাবে?
জ্বি। যন্ত্রটা এই ঘরে ফিট করা হয়েছে, কাজেই এই ঘরে পনেরো বিশ কুড়ি বছর আগে কী হয়েছিল সেটা দেখা যাবে।
এমন যন্ত্র সত্যি তৈরি হবে?
জ্বি হবে। হবে না, হয়েছে। আমি পরীক্ষাও করেছি।
মাহতাব উদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে বললেন, পরীক্ষায় কী দেখলে?
দেখলাম এই ঘরে একজন মহিলাকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো। মহিলার চোখ নীল।
তাই দেখলে?
জ্বি।
খুব ভালো যন্ত্র। পুরোপুরি তৈরি হোক, তারপর আমাকে খবর দিও। আমি এসে দেখে যাব।
জ্বি আচ্ছা।
অন্ধকারে কাজ করছ কীভাবে?
আমার অসুবিধা হয় না।
অসুবিধা না হলে তো ভালোই।
মাহতাব উদ্দিন আবার হাঁটতে শুরু করলেন। পুরোপুরি অন্ধকার না হওয়া। পর্যন্ত তিনি ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হটলেন। এশার নামাজের। আজানের পর তিনি নিচে নামলেন। আজ সারাদিন টুনটুনির সঙ্গে দেখা হয় নি মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। বারেক খবর দিয়েছে টুনটুনির জ্বর। চারদিকে ভাইরাস ফিভার হচ্ছে। টুনটুনিকেও কোনো একটা ভাইরাসে ধরেছে কিনা কে জানে।
টুনটুনি ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল। মাহতাব উদ্দিন ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। টুনটুনি চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার চোখ লাল। মাহতাব উদ্দিন বললেন, জ্বর কি খুব বেশি রে মা?
টুনটুনি বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাকে অরণ্যের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছ না কেন? তাকে নিয়ে ছাদের চিলেকোঠায় আটকে রেখেছ। আমাকে কেউ ছাদে যেতে দিচ্ছে না।
মাহতাব সাহেব বললেন, খলিলুল্লাহ হোর জন্যে কী একটা যন্ত্র বানাচ্ছে। যন্ত্রটা পেয়ে তুই খুব সারপ্রাইজড হবি। সেই সারপ্রাইজটা যেন নষ্ট না হয় সে জন্যেই তোকে যেতে দিচ্ছি না।
যন্ত্রটা দিয়ে কী হয়?
কী হয় আগে বললে তো সারপ্রাইজ থাকবে না।
টুনটুনি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, বাবা, মানুষকে তালাবন্ধ করে রাখতে তুমি খুব মজা পাও—তাই না?
তার মানে?
চিলেকোঠার ঐ ঘরে তো তুমি আমার মাকেও তালাবন্ধ করে রাখতে।
মাহতাব সাহেব শান্ত গলায় বললেন, টুনটুনি, তোমাকে আমি বলেছি তোমার মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাকে তালাবন্ধ করে রাখা ছাড়া আমার দ্বিতীয় পথ ছিল না।
টুনটুনি তাকিয়ে আছে। তার চোখ রক্তাভ।
মাহতাব সাহেব বললেন, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আর কিছু বলতে চাও?
টুনটুনি বলল, না।
রাত একটা।
মাহতাব উদ্দিন তাঁর ঘরে বসে আছেন। তার সামনে মাথা নিচু করে বারেক দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব সাহেব বললেন, হাবীবুর রহমান সাহেবকে কাল ভালো ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করবে।
বারেক বলল, জ্বি করব।
মাহতাব উদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শান্ত গলায় বললেন, খলিলুল্লাহর একটা ব্যবস্থা আজ রাতেই করতে হবে। কী ব্যবস্থা বুঝতে পারছ?
পারছি।
আর যাই করে তাকে পানিতে ফেলবে না। পানিতে ফেলে কিছু করা যাবে না। এ অন্য জিনিস।
বারেক চাপা গলায় বলল, স্যার এই বিষয় নিয়া আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। আমাদের ইটের ভাটা আছে।
ঠিক আছে, এখন যাও।
রাত দুটা কুড়ি মিনিটে খলিলুল্লাহকে হাত-পা বেঁধে ইটের ভাটায় ফেলে দেয়া হলো।
রাত দুটা পঁচিশ মিনিটে টুনটুনির জ্বর খুব বাড়ল। গা দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে। মাহতাব উদ্দিন মেয়েকে বাথটাবে শুইয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি নিয়ে ডাক্তার আনতে ছুটে গেলেন। জ্বরের ঘোরে টুনটুনি পানির নিচে চলে গিয়েছে। তখন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো। টুনটুনি লক্ষ করল সে পানির নিচে ডুবে থাকতে পারছে, তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে একসঙ্গে অসংখ্য নারী পুরুষের গলা শুনছে। সবাই বলছেটুনটুনি, দ্বিতীয় মানব সম্প্রদায়ের জগতে স্বাগতম। তুমি এখন আমাদের একজন।