কী যন্ত্র?
আমাদের জানা নেই এমন।
আপনি বলেন কী যন্ত্র বানাতে চান।
জালাল খাঁ আগ্রহ নিয়ে বললেন, একটা টাইম মেশিন কি বানোননা যায় এইচ জি ওয়েলস-এর টাইম মেশিন।
সেই মেশিনে কী হয়?
সেটা একটা অদ্ভুত মেশিন। এই মেশিনে করে মানুষ অতীত থেকে বর্তমানে আসতে পারে। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে যেতে পারে।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
জালাল খাঁ উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে এমন ভঙ্গিতে বলা শুরু করলেন যেন টাইম মেশিন বানাতে পারে এমন একজন ইনজিনিয়ার ভার সামনে বসে আছে। ব্যাপারটা শুধু বোঝানোর অপেক্ষা, বোঝানো হয়ে গেলে টাইম মেশিন তৈরি হয়ে যাবে। তাৎক্ষণিক ডেলিভারি।
মেশিনটা হবে এরকম—মনে করে আমি মেশিনটায় বসলাম, সুইচ টিপলাম। অমনি আমি চলে গেলাম অতীতে, যখন আমার বাবার বয়স মাত্ৰ সাত বছর।
এই যন্ত্র তৈরি করা যাবে না।
কেন তৈরি করা যাবে না?
নিয়মের মধ্যে পড়বে না।
কিসের নিয়ম?
জগতের নিয়ম। এই যন্ত্র তৈরি হলে জগতের নিয়মে গণ্ডগোল হয়ে যাবে। জগতের নিয়মে গণ্ডগোল হয় এমন কিছু জগৎ তৈরি করতে দেয় না।
জালাল খাঁ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। টাইম মেশিন ফিজিক্সের সূত্র গ্রহণ করে না। ধররা আমি যদি অতীতে ফিরে গিয়ে আমার সাত বছর বয়সী বাবাকে মেরে ফেলি তাহলে কী হবে? তাহলে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব? আমার বাবাই তো সাত বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি বড় হয়ে বিয়ে করতে পারেন নি। কাজেই আমার জন্ম হয় নি। তাহলে আমি কোত্থেকে এলাম?
অরণ্য এক দৃষ্টিতে জালাল খাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চাপা কৌতূহল। যেন সে কিছু বলতে চায়। জালাল খাঁ বললেন, তুমি কিছু বলবে?
আমি আম্মাজির জন্যে একটা যন্ত্র বানাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কার জন্যে যন্ত্র বানাবে, টুনটুনির জন্যে?
জি।
কী যন্ত্র?
আম্মাজি এই যন্ত্রে তার মায়ের কথা শুনতে পাবে। অনেক কাল আগে যে সব কথা বলেছিল সে সব কথা।
কীভাবে?
মানুষের কথা নষ্ট হয় না। মানুষের কথা থেকে যায়। ঘরের দেয়ালে থাকে, বাতাসে থাকে। সেখান থেকে কথা বের করে আনা যাবে।
কীভাবে?
সেটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আপনাকে বোঝাতে পারব না।
যন্ত্রটা তৈরি করতে তোমার কী লাগবে?
কলমের মতো একটা যন্ত্র যে আপনার আছে সেটা লাগবে। আরো কিছু জিনিস লাগবে।
তোমার যা যা লাগবে সবই আমি জোগাড় করে দেব। তুমি যন্ত্রটা বানাও। আমরা এই যন্ত্রের নাম দেব Past Rocorder, PR। বাংলায় তার নাম হবে অতীত-কথন। আচ্ছা তুমি কি যন্ত্রটা একা একা তৈরি করতে পারবে? তোমাকে সাহায্য করার লোক লাগবে না?
আমাকে সাহায্য করার লোক আছে। কোথায় আছে?
অরণ্য জবাব দিল না। চুপ করে বসে থাকল। সে এখন তাকিয়ে আছে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। বুড়ো আঙুল উঠানামা করছে।
জালাল খাঁ তার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি কে?
অরণ্য বলল, আমি জানি না আমি কে? বলেই সেও জালাল খাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আপনি কি জানেন আপনি কে? জালাল খাঁ হতাশ গলায় বললেন, আমিও জানি না আমি কে।
চিকিৎসার জন্যে ঢাকা
হাবীবুর রহমান সাহেব চিকিৎসার জন্যে ঢাকা চলে এসেছেন। খালি হাতে আসেন নি-তিন কেজি মাষকলাইয়ের ডাল, পাঁচ কেজি কালিজিরা পোলাওয়ের চাল, দুটা বিশাল সাইজের মিষ্টিকুমড়া নিয়ে এসেছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে মাহতাব সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। হ্যান্ডশেকের পর কোলাকুলি করলেন। মাহতাব সাহেবের বাড়িঘর দেখে বেচারা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছেন। এই জিনিস তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। বসার ঘরের মেঝের অর্ধেকটা মার্বেলের, বাকি অর্ধেক মনে হচ্ছে কাচের, নিচ থেকে সবুজ আলোর আভা আসছে। হাবীবুর রহমান সাহেব বললেন, ভাইসাহেব, ভালো আছেন?
মাহতাব উদ্দিন বললেন, ভালো আছি।
যাকে পাঠিয়েছিলাম, খলিলুল্লাহ, সে কেমন আছে?
সেও ভাল আছে।
তার মাধ্যমেই আপনার সঙ্গে পরিচয়, জগতের কী অদ্ভূত লীলা।
অদ্ভূত লীলা তো বটেই!
জনাব, আপনি বলেছিলেন আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।
মাহতাব উদ্দিন শুকনো গলায় বললেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা অবশ্যই করা হবে। আপাতত বিশ্রাম করুন। আপনাকে গেস্টম দেখিয়ে দেবে।
শুকরিয়া। জনাব, খলিলুল্লাহর সঙ্গে একটু কথা বলি। সে আছে কোথায়?
সে ভালো মতেই আছে। তার সঙ্গে আপনার কথা বলার প্রয়োজন দেখছি। না।
না না, কোনো প্রয়োজন নাই। সে থাকবে তার মতো। আমি থাকব আমার মতো। আমার খুবই ভালো লাগছে যে আপনার আশ্রয়ে এসে দরিদ্র মানুষটার একটা গতি হয়ে গেল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা উপলক্ষ মাত্র। জনাব, কেবলা কোনদিক? তিন ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়েছে। মাগরেবের ওয়াক্তও হয়ে গেছে।
আপনি আপনার ঘরে যান। কেবলা কোনদিকে তা আপনাকে দেখিয়ে দেবে জায়নামাজ এনে দেবে।
জায়নামাজ আমার সঙ্গেই থাকে জনাব। জায়নামাজ আর কোরান শরিফ। এই দুটা জিনিস ছাড়া আমি ঘর থেকে বের হই না। ছোটবেলার অভ্যাস।
মাহতাব উদ্দিন বসার ঘর থেকে বের হলেন। এখন সন্ধ্যা হয় হয়। বাসায় যখন থাকেন সন্ধ্যাবেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করেন। সূর্যাস্ত দেখেন। গ্রামে সূর্যাস্ত দেখার একরকম আনন্দ। শহরে দালানকোঠার ঘরে খলিলুল্লাহকে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ঘরটিও তালাবন্ধ। তাতে খলিলুল্লাহর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে নিজের মনেই আছে। এই ঘরটা বেশ বড়। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছানো। পাটিভর্তি হাজারো খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি। দুটা কম্পিউটারের মাদারবোের্ড। একটা মনিটর। ইলেকট্রিকের তার। সোল্ডারিং গান। খলিলুল্লাহ যা যা চেয়েছে জালাল খাঁ খবই জোগাড় করে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে ইলেকট্রনিকের দোকানে ছেড়ে দিয়েছেন। সে যা যা চেয়েছে সবই তাকে দেয়া হয়েছে। প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের একটা মোমের টুকরার উপর জিনিসগুলি বসেছে। মোমের টুকরাটি মনে হয় মূল বেস। প্রতিদিন তাকে প্রচুর বরফ দিতে হচ্ছে। বরফ কী জন্যে লাগছে কে জানে। বরফের আপাতত কোনো ব্যবহার দেখা যাচ্ছে না।