জালাল খাঁ বললেন, তাহলে তাকে বরং মানুষ হিসেবে ধরে নিয়ে এগোতে থাকি। ধরা যাক সে মানুষ, তবে অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ। Homo superior.
মাহতাব উদ্দিন বললেন, Homo superior ব্যাপারটা কী? তুই আগেও একবার বলেছিস।
জালাল খাঁ বললেন, জন বেরেসফোর্ড নামের একজন লেখক The Hampdensire Wonder নামে একটা বই লিখেছিলেন। বইটা ১৯১১ সনে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বই-এ তিনি Homo superior-এর কথা প্রথম বলেছেন। তার ধারণা পৃথিবীর বর্তমান মানবসম্প্রদায়ের পরিবর্তে নতুন মানবসম্প্রদায় চলে আসবে। তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও তাদের থাকবে অস্বাভাবিক ক্ষমতা। এরাই পৃথিবী শাসন করবে। এরাই গ্রহ-নক্ষত্র জয় করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
এরা আসবে কোত্থেকে?
মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে Homo superior তৈরি হবে। এরা হলো কার্টুনে দেখা কল্পনার Superman।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ? বিবর্তিত হয়ে মানুষ এরকম হবে?
জালাল খাঁ বললেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদের সমস্যা হচ্ছে এই থিওরি অতীতের বিবর্তনের ধারা বলতে পারে কিন্তু ভবিষ্যতে কী বিবর্তন হতে যাচ্ছে তা বলতে পারে না। মানুষের ডিএনএ-র পরিবর্তনটা কীভাবে হবে ডারউইনের থিওরি সেটা বলছে না। হঠাৎ করে একজন Homo superior তৈরি হবে না-কি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এদের দেখা যাবে তা কেউ বলতে পারছে না।
জালাল, তোর ধারণা খলিলুল্লাহ নামের মাটিকাটা কুলি একজন Homo superior?
হতে পারে। তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা তো চোখের সামনে দেখছি। যন্ত্রপাতির উপর তার কী পরিমাণ দখল সেটাও দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের এখন করণীয় কী?
আমাদের করণীয় একটাই–অরণ্যের সঙ্গে কথা বলা। তার সাহায্য নিয়েই বের করা সে কে? তার DNA-র সিকোয়েন্সগুলি কী তা জানা। যে পড়াশোনা জানে না তাকে পড়াশোনা শেখাননা। সে যদি Homo superior হয় তাহলে মানবসম্প্রদায়ের অর্জিত জ্ঞানের সবটুকু সে নিজের ভেতর অতি দ্রুত নিতে পারবে।
মাহতাব উদ্দিন বললেন, কতক্ষণ পার হয়েছে দেখ তো?
এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট।
তাকে কি ডেকে তুলব না সে আরো কিছুক্ষণ পানিতে থাকবে?
জালাল খাঁ বললেন, থাকুক পানিতে। আমাকে তুই একটা কাগজ কলম দে। তাকে যে সব প্রশ্ন করব তা লিখে ফেলি। থাক কাগজ কলম লাগবে না। জালাল খাঁ পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাহতাব উদ্দিনও তাকিয়ে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। পুকুরের পানি শান্ত। সেখানে কোনো আলোড়ন নেই।
মাহতাব উদ্দিন সাহেবের বাগানবাড়ি
জালাল খাঁ মাহতাব উদ্দিন সাহেবের বাগানবাড়ির বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন। তাঁর সামনে বেতের চেয়ারে খলিলুল্লাহ বসে আছে। সব মিলিয়ে পানিতে দুঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট ছিল। এক ঘণ্টা হলো সে পানি থেকে উঠে এসেছে। সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করে সে এসে বসেছে বসার ঘরে। জালাল খাঁ তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান। মাহতাব উদ্দিনেরও এই আসরে থাকার কথা ছিল। তাঁর হঠাৎ প্ৰবল মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বলে তিনি অন্য একটা ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তাঁর মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। হঠাৎ হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যথা উঠে তাঁর জগৎ সম্পূৰ্ণ এলোমেলো করে দেয়। আজকের মাথা ব্যথার ধরন সেরকম।
জালাল খাঁ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছ?
অরণ্য বলল, ভালো আছি।
পানির নিচে থাকতে কেমন লাগে?
ভালো লাগে।
শুকনায় থাকতে ভালো লাগে না-কি পানিতে থাকতে ভালো লাগে?
দুটাই ভালো।
তোমাকে আমি কিছু প্রশ্ন করব, জবাব দেবে?
জ্বি, দেব।
তোমার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা যে আছে এটা তুমি জানো?
আগে জানতাম না। এখন জানি।
তুমি পানিতে ডুবে থাকতে পারো এটা দেখলাম। এছাড়া আর কী পারো? শূন্যেও ভেসে থাকতে পারো?
পারি।
জালাল খাঁ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো বললেন, তুমি শূন্যে ভেসে থাকতে পারো?
পারি।
তাহলে ভেসে দেখাও।
এখন পারব না।
কখন পারবে?
যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন পারি।
কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারো?
অনেকক্ষণ পারি।
তুমি কে এটা বললা।
আমি জানি না আমি কে।
তোমার কি জানতে ইচ্ছা হয় তুমি কে?
না।
কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি কে? তুমি আমাকে সাহায্য করো। তুমি সাহায্য করলেই আমি তোমার ব্যাপারে জানতে পারব। তুমি সাহায্য না করলে পারব না। আচ্ছা শোননা, তুমি কি রোবট?
রোবট কী?
রোবট হলো যন্ত্ৰমানব। যাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নেই, আবেগ নেই। তোমার ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে?
আছে।
আবেগ আছে? কষ্ট পেলে কাঁদো?
না।
কষ্ট পেলে কাঁদো না? কখনো তোমার চোখে পানি আসে নি?
একবার এসেছে।
সেটা কখন?
আম্মাজি তার মার কথা বলছিল। তার মাকে সে কখনো দেখে নাই। মার কথা বলতে গিয়ে সে এত মন খারাপ করল যে আমার চোখে পানি এসে গেল।
এর অর্থ হচ্ছে তোমার আবেগ আছে। আচ্ছা, তুমি তোমার বাবা-মাকে মনে করতে পারো? তারা কোথায়?
জানি না।
বাবা-মার কথা কিছুই জানোনা?
আমার কিছু মনে নাই। একবার আমার খুব বড় অসুখ হয়েছিল। অসুখ হবার পর অসুখের আগের সবকিছু ভুলে গেছি।
কী অসুখ হয়েছিল? মাথায় যন্ত্রণা।
দুঃস্বপ্ন দেখতাম।
কী দুঃস্বপ্ন?
নানান রকম কলকজা ঘুরছে। অদ্ভুত অদ্ভুত যন্ত্র। অসুখের সময় বড় কষ্ট করেছি।
জালাল খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যন্ত্রের কথায় মনে পড়ল তুমি নষ্ট যন্ত্রপাতি ঠিক করতে পারে। এই প্রমাণ আমরা দেখেছি। যে নষ্ট যন্ত্র ঠিক করতে পারে সে যন্ত্র বানাতেও পারে। তুমি যন্ত্র তৈরি করতে পারবে?