টুনটুনি খলিলুল্লাহর ঘরে বসে আছে। সে বসেছে চেয়ারে। খলিলুল্লাহ দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছে। টুনটুনি বলল, আপনাকে যে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে এতে কি আপনার খারাপ লাগছে?
না।
খারাপ লাগছে না কেন?
আম্মাজি, আমার কোনো কিছুতেই খারাপ লাগে না।
আমাকে আপনি আম্মাজি ডাকেন কেন?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না, হাসল।
আপনার মা কি দেখতে আমার মতো ছিলেন।
আমার মায়ের কথা আমার মনে নাই।
মাকে কখনো দেখেন নি?
মনে নাই।
আপনার বাবাকে আপনি দেখেছেন?
মনে নাই।
আপনার কিছুই মনে নাই এটা কেমন কথা?
আম্মাজি, আমার একবার খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল। অসুখের পর আগের কথা সব ভুলে গেছি।
কী অসুখ হয়েছিল?
মাথায় যন্ত্রণা হয়েছিল। এমন যন্ত্রণা যার কোনো মা-বাপ নাই। তখন চোখের সামনে শুধু কলকজা দেখতাম।
স্বপ্নে দেখতেন?
স্বপ্নে দেখতাম না বাস্তবে দেখতাম সেটা খেয়াল নাই। শুধু দেখতাম কলকবজা। বড় কষ্ট করেছি। অসুখ অনেকদিন ছিল।
এখন সেই স্বপ্ন দেখেন না?
না, এখন অন্য কিছু দেখি।
কী দেখেন?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। হাসল। টুনটুনি বলল, আজ আমার খুব মন খারাপ।
খলিলুল্লাহ বলল, কেন মন খারাপ? আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন। বাবা দিনটার কথা ভুলে গেছেন। আজ তোমার মায়ের মৃত্যুদিন।
হ্যাঁ। আপনার যেমন আপনার মায়ের কথা কিছু মনে নেই আমারও আমার মায়ের কথা কিছু মনে নেই। আমার যখন দুবছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। দুবছর বয়সের স্মৃতি মানুষের মাথায় থাকে না।
তোমার বাবা আর বিয়ে করেন নি?
বিয়ে করেছিলেন। নতুন মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। চিটাগাং থেকে ঢাকা আসার পথে রোড এক্সিডেন্ট হয়। ড্রাইভার এবং মা দুজনই মারা যান। বাবা আহত হয়েছিলেন। অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
টুনটুনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আসল মার কথা আমার মনে নেই, কিন্তু নতুন মার কথা মনে আছে। উনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমার টুনটুনি নাম উল্টো করে আমাকে ডাকতেন নিটুনটু। আচ্ছা আপনি ঘুমান, আমি উঠি। আপনার ঘর আমি তালাবন্ধ করে রাখব, আপনি রাগ করবেন না।
আমি রাগ করব না।
আপনার যদি কখনো মনে হয় আপনি এখানে থাকবেন না, পালিয়ে যাবেন-তাহলে আমাকে বলবেন, আমি গভীর রাতে এসে তালা খুলে দেব। আপনি বাড়ির পেছনে চলে যাবেন, সেখান থেকে দেয়াল টপকে পালিয়ে যাবেন। পারবেন না?
হ্যাঁ পারব।
টুনটুনি খলিলুল্লাহর দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।
মাহতাব উদ্দিন ঘুমুতে গেলেন রাত একটায়। ঘুমুতে যাবার আগে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একটা ডরমিকাম খেলেন। সাত মিলিগ্রামের ডরমিকম, নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্যে যথেষ্ট। ঘুমের ওষুধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাবার নাকি নিয়ম নেই। পাঁচ দশ মিনিট পরে যেতে হয়। শরীর বিলাক্স করার জন্যে সামান্য হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বিছানায় যাবার ঠিক আগে আগে এক কাপ গরম দুধ এবং এক গ্লাস হিম শীতল পানি খেতে হয়। তিনি সবই করলেন কিন্তু তার ঘুম এলো না। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা প্রথমে দেয়ালে তারপর দেয়াল থেকে তার মাথার ভেতরে কট কট করতে লাগল। তিনি বিছানা থেকে উঠে ঘড়ি নামিয়ে তার ব্যাটারি খুলে রাখলেন। তারপরেও সেকেন্ডের কাটার কটকটানি বন্ধ হলো না। মাথার ভেতর কট কট করতেই থাকল।
তাঁর ঘুম এলো ফজরের নামাজের পর। ঘুমের মধ্যে তিনি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘুম ভাঙতেই চারদিকে লালাভ আলো দেখতে পেলেন। সেই সঙ্গে শো শোবিজ বিজ শব্দ। ব্যাপারটা কী জানার জন্যে চারদিকে তাকাচ্ছেন, হঠাৎ চোখ পড়ল ঘরের মেঝের দিকে। ঘরের মেঝেটা বদলে গেছে। এটা এখন আর মেঝে না, গলিত লাভার মতো হয়ে গেছে। লাভা ফুটছে। বুদবুদ ভাঙছে। সেখান থেকেই বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে। ঘটনা কী? তিনি কি কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আগ্নেয়গিরির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন? তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে খাটে উঠে বসলেন এবং লক্ষ করলেন তার রট আয়রনের খাটের পায়া জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভাতে গলে গলে যাচ্ছে তিনি দ্রুত নেমে যাচ্ছেন লাভা সমুদ্রে। যে দিকে চোখ যাচ্ছে গলন্ত লভা।
শোঁ শোঁ শব্দ আসছে। শব্দটা হচ্ছে ঠিক মাঝখানে। কোনো একটা ঘটনা সেখানে ঘটছে। ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা। মাহতাব সাহেব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বের হয়ে আসছে। একটা মানুষের মাথা। মানুষটা কে? খলিলুল্লাহ? হ্যাঁ খলিলুল্লাহই তো। মাহতাব সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, কী চাও তুমি, কী চাও?
মানুষের মাথার মুখ হা হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, আমি কিছু চাই না।
চলে যাও তুমি, চলে যাও।
কোথায় চলে যাব?
যেখান থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও।
যাব কীভাবে? আপনি তো আমাকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন!
মাহতাব সাহেব স্বপ্নের ভেতর চেঁচাচ্ছেন টুনটুনি, চাবি দিয়ে তালা খুলে দে। চলে যাক। এ যেখান থেকে এসেছে সেখানে চলে যাক।
মাহতাব উদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন তাঁর সারা শরীর ঘামে ভেজা।
টুনটুনি তার ম্যাকিনটস কম্পিউটারের সামনে
টুনটুনি তার ম্যাকিনটস কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সে খুব অবাক হয়ে কম্পিউটারের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। পর্দায় অরণ্যর ছবি। স্ক্র্যাপ বুক বানানোর জন্যে সে ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলি কম্পিউটারে ঢুকিয়েছে। আগে তোলা ছবি এবং পরে তোলা ছবি পাশাপাশি দেখে তার খুবই অবাক লাগছে। প্রথমদিকে তোলা ছবিগুলির সঙ্গে শেষের দিকে তোলা ছবির বড় অমিল আছে। চোখের মণির রঙে অমিল। প্রথম যে ছবিগুলি তোলা হয়েছিল সেখানে চোখের মণির রঙ কালো। এখনকার ছবিতে হালকা নীল।