আমার বড় বৌমা তাহার শাশুড়ি মাতার সহিত (অর্থাৎ আমার স্ত্রী) যে আলাপ করিয়াছে তাহা অতি সম্প্রতি আমি আমার স্ত্রীর নিকট হইতে উদ্ধার করিয়াছি। আপনার জ্ঞাতার্থে আপনাকে তাহা জানাইতেছি। আমার বড় বৌমার ধারণা খলিলুল্লাহ মানুষ নহে, সে জিন।
জিন ও ইনসানের কথা পবিত্র কোরান শরিফে উল্লেখ আছে। হযরত সোলায়মান আয়হেস সালামের অধীনে জিন সম্প্রদায় কর্মকাণ্ড করিত ইহাও কোরান শরিফে উল্লেখ আছে।
আপনার অবগতির জন্য জানাইতেছি সর্বমোট তিন প্রকারের বুদ্ধিমান সম্প্রদায় আল্লাহপাক সৃষ্টি করিয়াছেন। যেমন ফেরেশতা। ইহারা আগুনের তৈয়ারি। ইহারা সন্তান সন্ততির জন্ম দিতে পারে না। ইচ্ছামতো যে-কোনো রূপ ধারণ করতে পারে।
ফেরেশতাদের পরেই আছে জিন সম্প্রদায়। ইহারাও আগুনের তৈয়ারি। তবে ইহারা সংসারধর্ম পালন করে। সন্তান সন্ততির জন্ম দেয়। মানুষের মতোই ইহাদেরও জন্ম-মৃত্যু আছে। শয়তান (ইবলিশ) জিন সম্প্রদায়ভুক্ত। যদিও অনেকে শয়তানকে পথভ্ৰষ্ট ফেরেশতা মনে করে। ইহা সঠিক না।
বড় বৌমা কেন খলিলুল্লাহকে জিন ভাবিয়াছে তাহা আমি বলিতে পারি না। তবে ইহা অবশ্যই সত্য নয়। মেয়েছেলেরা দুর্বলচিত্ত হইয়া থাকে। রজ্জ্বকে সর্প ভ্রম করা তাহাদের স্বভাব।
জনাব আপনার নিকট দীর্ঘ পত্ৰ দিয়াছি। পত্রের দোষত্রুটি নিজগুণে ক্ষমা করিবেন। আল্লাহপাক আপনার মঙ্গল করুক।
ইতি
নাদান
হাবীবুর রহমান
চিঠি পড়তে পড়তে
চিঠি পড়তে পড়তেই মাহতাব সাহেবের মাথা ব্যথা ফিরে এল। চোখ টনটন করতে লাগল। আজ কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি কি বেশি টেনশান করছেন? বাড়াবাড়ি ধরনের এই টেনশানের মানে কী?
মাহতাব সাহেব টেলিফোন হাতে নিলেন। জালাল খাঁর সঙ্গে কথা বললে যদি টেনশান কিছু কমে। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। জালাল নিজে টেনশানমুক্ত জীবনযাপন করে। যে নিজে টেনশানমুক্ত জগতে বাস করে সে অন্যদের টেনশান দূর করতে পারে না।
হ্যালো জালাল?
হ্যাঁ। কে?
চিনতে পারছি না কে?
না।
আমি মাহতাব।
ও আচ্ছা তুই। তোর টেলিফোন পাব এটা আমি ভাবছিলাম। অরণ্যের খবর কী?
জানি না কী খবর। তাকে তালাবন্ধ করে রেখেছি।
সে-কী! কেন?
আমি তার ব্যাপারে কনফিউজড।
কনফিউজড হলেই তাকে তালাবন্ধ করে রাখতে হবে? তুই একটা কাজ কর। তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।
অসম্ভব! তাকে আমি হাতছাড়া করব না।
জালাল খাঁ হেসে ফেললেন। মাহতাব বললেন, তুই হাসছিস কেন?
তুই অসম্ভব রকম টেনস্ হয়ে আছিস এই জন্যে হাসছি। আমার ধারণা তোর প্রেসার বেড়েছে। ড্রপ বিট হচ্ছে। তুই একজন ডাক্তার ডেকে আন।
জালাল শোন, আগামী বৃহস্পতিবারে তোর কি অবসর আছে?
আমার সব দিনই অবসর, আবার সবদিনই ব্যস্ততা।
বৃহস্পতিবারটা তুই অবশ্যই অবসর রাখবি। আমার বাগানবাড়িতে যাবি। সেখানে খলিলুল্লাহকে নিয়ে জটিল একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।
তুই বারবার তাকে খলিলুল্লাহ বলছিস কেন? টুনটুনি তার নাম দিয়েছে। অরণ্য। তাকে অরণ্য ডাকবি। মাহতাব শোন, আমি তোর এই অদ্ভুত মানুষ নিয়ে ভাবছি। কিছু পড়াশোনা করছি। আমার ধারণা সে Homo superior।
Homo superior কী?
ডারউইনের এডভালিউশনের ধারায় মানুষের পরের বিবর্তন হলো Homo superior |
ভালো করে বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে বলার সময় এখনো আসে নি। যখন সময় আসবে তখন বুঝিয়ে বলব। মাহতাব, আমি টেলিফোন রাখলাম। পড়ার মাঝখানে কেউ টেলিফোন করলে আমার খুবই বিরক্তি লাগে।
মাহতাব সাহেব খানিকটা বিব্রত গলায় বললেন, তোকে একটা হাস্যকর প্রশ্ন করছি, তুই কিন্তু হাসবি না।
জালাল খাঁ বললেন, তুই কন্ট্রাডিকটরি কথা বলছিস। হাস্যকর কথা বলবি অথচ আমি হাসতে পারব না? আচ্ছা চেষ্টা করব না হাসতে, বল কী কথা?
এমন কি হতে পারে যে খলিলুল্লাহ আসলে মানুষ না। জিন।
জিন?
হ্যাঁ, জিন।
মাটির কলসিতে যারা বন্দি থাকে তারপর ধোয়া হয়ে বের হয় সেরকম কিছু?
মাহতাব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই আমার কথাগুলি ফানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমি ফান করছি না।
জালাল খাঁ বললেন, তোর ঘরে কি ঘুমের ওষুধ আছে?
আছে।
কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি ভোরবেলা তোর সঙ্গে কথা বলব। সকালে তুই আরেকটা কাজ করবি—অরণ্যকে কোনো এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি। ডাক্তার তার ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করবে, ইসিজি নেবে। ডাক্তার যখন বলবে অরণ্যের ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ তখন নিশ্চয়ই ভাববি না যে অরণ্য মানুষ না জিন। জিনদের ও পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ থাকার কথা না।
খলিলুল্লাহর ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ তোকে কে বলল?
কেউ বলেনি, কথার কথা বলছি। তুই কি আর কিছু বলবি?
না।
আমি কি টেলিফোন নামিয়ে রাখতে পারি?
মাহতাব সাহেব কিছু বললেন না। জালাল খাঁ টেলিফোন নামিয়ে রাখার পরেও তিনি বেশ কিছু সময় রিসিভার কানে নিয়ে বসে রইলেন।
ঘড়িতে এখন এগারোটা বাজে। টুনটুনির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়া যাবে না। মাহতাব সাহেব দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেকেন্ডের কাটা নড়ার কট কট শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি যে উত্তেজিত এই কট কট শব্দ তার প্রমাণ। উত্তেজিত হলেই সেকেন্ডের কাঁটা নড়ার কট কট শব্দ তিনি শুনতে পান। ঘড়িটি কি দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলবেন?
এখন বাজছে এগারোটা এক। আশ্চর্য, মাত্র এক মিনিট পার হয়েছে? সময় কি থমকে গেছে? মাহতাব সাহেবের মনে হচ্ছে তিনি অনন্তকাল ধরে বসে আছেন। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার কট কট শব্দ শুনছেন।