দরজায় টোকা পড়ছে। মাহতাব সাহেব বললেন কে?
টুনটুনির গলা শোনা গেল। টুনটুনি বলল, বাবা আমি। আমি কি ভেতরে আসব?
মাহতাব সাহেব বললেন, দরজা খোলা আছে। মা, তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি আমি তোমাদের স্কুলের হেড মিসট্রেস না। আমার ঘরে ঢোকার সময় তোমার অনুমতি নিতে হবে না। যখন ইচ্ছা ঘরে ঢুকবে। যখন ইচ্ছা বার হয়ে যাবে।
টুনটুনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। মাহতাব সাহেবের ঘরে খাটের পাশে কার্পেটের উপর আখরোট কাঠের একটা রকিং চেয়ার আছে। টুনটুনি রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে লাগল। তার মুখ বিষন্ন। মাহতাব সাহেব বললেন, মা, কোনো কারণে তোমার কি মন খারাপ?
টুনটুনি জবাব দিল না। মাহতাব সাহেব বললেন, মা শোন, তোমার সঙ্গে আমার একটা অলিখিত চুক্তি আছে। চুক্তিটা মনে আছে?
মনে আছে।
বলো দেখি চুক্তিটা কী?
আমার যদি মন খারাপ হয় তাহলে কেন মন খারাপ সেটা তোমাকে জানাব।
মাহতাব সাহেব মেয়ের সামনে বসতে বসতে বললেন, টুনটুনি মা শোনো। তোমার মা বেঁচে নাই। তোমার মা বেঁচে থাকলে তিনি নিজেই বের করে ফেলতেন কেন তোমার মন খারাপ। মা-দের পক্ষে অনেক কিছু সম্ভব যা বাবাদের পক্ষে সম্ভব না। কাজেই তোমাকেই মুখ ফুটে বলতে হবে কেন তোমার মন খারাপ।
টুনটুনি দোল খাওয়া বন্ধ করে বলল, অরণ্যকে তুমি তালাবন্ধ করে রেখেছ কেন?
অরণ্যটা কে?
অরণ্য কে তুমি খুব ভালো করে জানো। আমি খলিলুল্লাহ নাম বদলে অরণ্য নাম দিয়েছি।
মাহতাব সাহেব শীতল গলায় বললেন, মা, একটু কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? তার নাম তুমি বদলাবে কেন?
টুনটুনি বলল, বাবা, তুমিও কি একটু বাড়াবাড়ি করছ না। তাকে তুমি কেন তালাবন্ধ করে রাখবে? আমাদের এই বাড়িটা তো জেলখানা না। এবং সে এমন কোনো অপরাধও করে নি।
তাকে তালাবন্ধ করে রেখেছি এই জন্যে কি তোমার মন খারাপ?
টুনটুনি জবাব দিল না। আবারো দোল খেতে লাগল। মাহতাব সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, খলিলুল্লাহকে শাস্তি দেবার জন্যে তালাবন্ধ করে রাখা হয় নি। ও যেন চলে যেতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি লোকটির কর্মকাণ্ডে শঙ্কিত। আমি স্বস্তি বোধ করছি না। আমার মনে হচ্ছে something is wrong somewhere.
তুমি কি লোকটাকে ভয় পাচ্ছ?
হয়তো পাচ্ছি। যারা স্বাভাবিক মানুষ তারা অস্বাভাবিক মানুষের আশেপাশে অস্বস্তি বোধ করে। কালো আফ্রিকানদের দেশে প্রথম যখন সাদা চামড়ার মানুষ গেল, আফ্রিকানরা সেই সাদা চামড়ার মানুষকে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলল। শুধু যে মেরে ফেলল তা না, আগুন দিয়ে ঝলসে খেয়েও ফেলল। একইরকম ঘটনা ঘটল সাদা চামড়াদের দেশে। তাদের কাছে যখন হঠাৎ কালো চামড়ার একজন এসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে অশুভ মানুষ হিসেবে তাকে পুড়িয়ে মারা হলো।
তুমি অরণ্যকে ভয় পাছ?
অরণ্য অরণ্য করবে না মা। তার যা নাম তাকে তাই ডাকো। সেটাই শোভন ও সুন্দর।
তুমি খলিলুল্লাহ ভাইকে ভয় পাচ্ছ?
হ্যাঁ, পাচ্ছি। কিছুটা ভয় পাচ্ছি।
তাহলে একটা কাজ করো, ওকে ছেড়ে দাও। সে যেখানে থেকে এসেছিল সেখানে চলে যাবে।
এটা সম্ভব না।
সম্ভব না কেন?
সম্ভব না, কারণ আমি তাকে ছাড়ব না। আমার কাছ থেকে যাবার আগে সে তার সব রহস্য ভেঙে তারপর যাবে। আমি রহস্য পছন্দ করি না।
বাবা, আমি তোমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছি।
অবাক হলেও কিছু করার নেই। মা শোননা, আমার শরীরটা ভালো লাগছে। না। আমি শুয়ে পড়ব।
টুনটুনি বলল, তোমার সঙ্গে আমার যে লিখিত চুক্তি ছিল তার দুটা পার্ট আছে। প্রথম পার্টে আমি আমার মন খারাপের কথা তোমাকে বলব। দ্বিতীয় পার্টে আছে তুমি চেষ্টা করবে আমার মন খারাপ ভাবটা দূর করতে। তা কিন্তু তুমি করছ না।
কী করলে তোমার মন খারাপ ভাব দূর হবে? ওকে ছেড়ে দিলে? ওকে আমি ছাড়ব না। তালাও খোলা হবে না। তবে একটা কাজ করতে পারিতোমাকে তালার চাবিটা দিতে পারি। তোমার যখনই তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করবে তুমি তালা খুলে তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। কথা শেষ হবার পর আবার তালাবন্ধ করে ফেলবে। এবং চাবি আমার কাছে ফেরত দেবে। রাজি আছ?
হ্যাঁ, রাজি আছি।
মাহতাব সাহেব ড্রয়ার খুলে মেয়ের হাতে চাবি দিলেন। টুনটুনি চাবি নিয়ে চলে গেল। মাহতাব সাহেব বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিলেন। তার সারা শরীর কেন জানি জ্বালা করছে। বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে পারলে ভালো হতো। এখন তা করা যাবে না। টুনটুনি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মাহতাব সাহেব আবার তাঁর ড্রয়ার খুললেন। হাবীবুর রহমান সাহেবের কাছ থেকে যে চিঠি এসেছে সেটা আবার পড়লেন
চৌধুরী সাহেব,
আসসালাম। আপনার পত্ৰ পাইয়াছি। আপনি অতি মহানুভব ব্যক্তি। আপনি আমাকে ঢাকায় আসিতে বলিয়াছেন। আমার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করিবেন বলিয়া জানাইয়াছেন। আমি যুগপৎ আনন্দিত ও বিস্মিত হইয়াছি। আজকালকার যুগে এতটা কেউ করে না। আমি অতি দ্রুত ঢাকা আসিবার ব্যবস্থা করিতেছি।
আপনার কথামতো বড় বৌমার নিকট খলিলুল্লাহর বিষয়ে সন্ধান নিব বলিয়া মনস্থির করিয়াছি। এখননা ব্যবস্থা নিতে পারি নাই। আপনি আমার বড় বৌমার সহিত সাক্ষাতে আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। ইহা আমার জন্যে অতীব সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু জনাব আমার বড় বৌমার পিতামাতা অত্যন্ত রক্ষণশীল ধারার মানুষ। তের বৎসর বয়স হইতেই বড় বৌমার বাপের বাড়ির সকল মেয়েদের বোরকা পরিধান করতে হয়। এমতাবস্থায় আপনাকে ঐ বাড়িতে নিয়া গেলেও বিশেষ সুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয় না। তবে বড় বৌমা সন্তান প্রসবের পর আমার বাড়িতে আসিলেই আপনি তাহার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারিবেন।