তোমার নাম অরণ্য?
জ্বি।
তুমি লেখাপড়া জানো?
জানতাম না। এখন শিখছি।
কে শেখাচ্ছে।
আম্মাজি শিখাচ্ছেন।
আম্মাজিটা কে?
আম্মাজির নাম টুনটুনি।
ও আচ্ছা, আমাদের টুনটুনি হলো শিক্ষিকা? খুব ভালো। কতদিনে লেখাপড়া শিখে ফেলতে পারবে বলে তোমার ধারণা।
বেশিদিন লাগবে না।
শুনেছি তুমি গ্রামে থাকতে। মাটি কাটার কাজ করতে। এটা কি সত্যি?
জ্বি সত্যি।
গ্রামের একজন মাটি কাটা শ্ৰমিক গ্রাম্য ভাষায় কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছ।
আম্মাজি আমাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলেছেন।
তোমার আম্মাজি তোমাকে যা বলে তাই করো?
খলিলুল্লাহ কিংবা অরণ্য এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে জালাল খাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। এই হাসিতে কোনো সংকোচ নেই, দ্বিধা নেই।
জালাল খাঁ বললেন, শুনেছি তুমি ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে সারতে পারো।
ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি কী আমি জানি না। রেডিও-টিভি সারতে পারি।
আমার সঙ্গে একটা ডিভিআর আছে। ডিভিআর হলো ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার। জিনিসটা দেখতে কলমের মতো। পকেটে রেখে দিলে আধ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষজনের কথাবার্তা রেকর্ড হয়। যন্ত্রটা কাজ করছে না। তুমি এটা ঠিক করতে পারবে?
খলিলুল্লাহ হাত বাড়িয়ে বলল, যন্ত্রটা দেন।
জালাল খাঁ ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারটা দিলেন। বারেক কফি নিয়ে এসেছে। জালাল খাঁ কফির মগ হাতে নিয়ে খলিলুল্লাহর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে কৌতুক ঝিকমিক করছে। তিনি যে ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার দিয়েছেন সেটা ঠিক আছে। বারো ভোল্টের নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারিটা রেকর্ডারে ফিট করা নেই। তিনি পকেটে করে নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি এনেছেন তবে সেই ব্যাটারি ক্যামেরার ব্যাটারি। ছয় ভোল্টের ব্যাটারি।
খলিলুল্লাহ কলমের মতো ছোট্ট জিনিসটা একবার ডান হাতে নিল। আরেকবার বাম হাতে নিল। সে যন্ত্রটার দিকে তাকাচ্ছে না। তবে তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। যেন সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে জটিল কোনো জিনিস বোঝার চেষ্টা করছে।
জালাল খাঁ বললেন, তোমার কাছে ছোট স্কু ড্রাইভার আছে? স্কু ড্রাইভার থাকলে যন্ত্রটা খুলে দেখ—কোন জিনিস নষ্ট না খুলে বুঝবে কী করে?
খলিলুল্লাহ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, যন্ত্রটা ঠিক আছে। যন্ত্র ঠিক আছে তাহলে চলে না কেন? খলিলুল্লাহ ব্যাটারি চেম্বার খুলে বলল, এই জায়গায় একটা জিনিস লাগবে।
ব্যাটারির কথা বলছ? এটা হলো ব্যাটারি চেম্বার। আমার কাছে একটা ব্যাটারি আছে। দেখ তো এটা দিয়ে হবে কি না।
খলিলুল্লাহ ব্যাটারি হাতে নিয়েই বলল, এটা দিয়ে হবে না। আচ্ছা দেখি, যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করি।
কী ব্যবস্থা করবে?
খলিলুল্লাহ হাসছে। ভালো কোনো ম্যাজিক দেখানোর আগে ম্যাজিসিয়ানরা যে ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি।
জালাল খাঁ লক্ষ করলেন খলিলুল্লাহ হাতের নখ দিয়ে ডিভিআর এর অতি ক্ষুদ্র স্কু খুলে ফেলছে। ভোলা স্তুগুলো কোথাও রাখছে না, হাতের তালুর ভাঁজেই আছে। কাজটা সে এত দ্রুততার সঙ্গে করছে যে মনে হচ্ছে হাতের নখ দিয়ে স্ক্রু খোলা হলো লোকটার পেশা। গত বিশ পঁচিশ বছর ধরে সে এই কাজই করছে।
কোন স্কু কোথায় লাগবে তোমার মনে আছে? একেকটা তো একেক রকম।
মনে আছে।
তোমার কতক্ষণ লাগবে?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। এখন সে কাজ করছে চোখ বন্ধ করে। জালাল খাঁ মাহতাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ছয় ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে বারো ভোল্টের ডিভিআর চলবে না। তোমার এই লোক কী করছে সেই জানে, তবে তার কর্মপদ্ধতি মজার। যন্ত্রপাতি সম্পর্কে এই লোক কিছু জানে না—তাও ঠিক না। সে অবশ্যই জানে। ডিভিআর হাতে নিয়েই সে বলেছে এটা ঠিক আছে। ব্যাপারটা সত্যি হলেও আমার ধারণা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।
জালাল খাঁর কথার মাঝখানেই খলিলুল্লাহ বলল, স্যার নেন। এখন ঠিক হয়েছে।
ঠিক হয়েছে মানে?
খলিলুল্লাহ ছোট্ট করে নিশ্বাস নিল। জালাল খাঁ ভয়েস রেকর্ডার হাতে নিলেন। বোতাম টিপে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো, ওয়ান টু থ্রি বললেন। রিপ্লে করলেন। ভয়েস রেকর্ডার থেকে কথা শোনা গেল হ্যালো হ্যালো, ওয়ান টু থ্রি।
জালাল বিস্মিত গলায় ইংরেজিতে বললেন, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। যন্ত্রের কোনো এক জায়গায় রেজিসটেন্স বদলাতে হয়েছে। সেটা কী করে সম্ভব আমি বুঝতে পারছি না। আমি পুরোপুরি কনফিউজড।
খলিলুল্লাহ বলল, স্যার আমি যাই?
জালাল খাঁ বললেন, যাও। যন্ত্রটা হাতে করে নিয়ে যাও। এটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম।
আমার দরকার নাই।
খলিলুল্লাহ চলে যাচ্ছে। জালাল খাঁ একবার তাকাচ্ছেন খলিলুল্লাহর দিকে, একবার তাকাচ্ছেন মাহতাব সাহেবের দিকে। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছেন না। মাহতাব সাহেবের ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে। কপাল ঘামছে। অবশ্যই প্রেসার বাড়ার লক্ষণ।
রাত দশটা বাজে।
মাহতাব ঘুমুবার আয়োজন করছেন। তিনি কখনোই রাত বারটার আগে ঘুমুতে যান না। আজ তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। বিকেল থেকেই প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা ছিল। কড়া পেইন কিলার খেয়ে মাথার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। যন্ত্রণা চলে গেছে কিন্তু সে তার পালক ফেলে গেছে। সেই পালকের নাম ভোতা অবসাদ। তিনি রাতে খাবার খান নি। হঠাৎ করে আবার এসিডিটি দেখা দিয়েছে। এন্ডােসকপির মতো কষ্টকর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আবার মনে হয় যেতেই হবে।