ফটোসেশন হলো ছবি তোলার কর্মকাণ্ড। আমার হাতে যে ক্যামেরাটা দেখছেন এই ক্যামেরাটা সাধারণ ক্যামেরা না। এর নাম ডিজিটাল ক্যামেরা। আমার একটা ম্যাকিনটস কম্পিউটার আছে। ডিজিটাল ক্যামেরায় আপনার ছবি তুলে কম্পিউটারের মেমোরিতে দিয়ে দেব। দেখতে আপনার খুব মজা লাগবে। আপনি যে সবুজ সার্ট পরে আছেন ইচ্ছা করলেই আমি ছবিতে সবুজ সার্টের রঙ বদলে দিতে পারব। আপনার চোখের কালো মণিগুলি নীল করে ফেলতে পারব।
চোখের মণি নীল করলে কী হয়?
আমার কাছে খুব ভালো লাগে। মনে হয় খানিকটা সমুদ্র চোখে চলে এসেছে। আমার মার চোখের মণির রঙ ছিল হালকা নীল।
খলিলুল্লাহ ছবি তোলার জন্যে সুইমিং পুলের পাশে চেয়ারে বসেছে। টুনটুনি চোখের সামনে ক্যামেরা ধরেছে। অটো ফোকাস ক্যামেরা। ক্যামেরা নিজেই ফোকাল লেংথ ঠিক করে জানান দেবে—সব ঠিক আছে, সাটারে চাপ দাও। ক্যামেরায় সবুজ বাতি জ্বলছে। টুনটুনি সাটারে টিপ না দিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল-আশ্চর্য তো আপনার চোখের মণি হালকা নীল। আমি আগে কেন লক্ষ করি নি? আমার ধারণা ছিল আপনার চোখের মণি কালো। এখন দেখছি নীল।
খলিলুল্লাহ হাসছে। টুনটুনি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় খলিলুল্লাহর দশটা ছবি তুলল।
জালাল খাঁকে আনতে গাড়ি গিয়েছিল
জালাল খাঁকে আনতে গাড়ি গিয়েছিল সন্ধ্যায়। তিনি এসেছেন রাত নটায়। পিটার নিকলস-এর একটা বই পড়ছিলেন—Holocaust and Catastrophe. বই হাত থেকে নামাতে পারছিলেন না বলে এত দেরি। বই-এর শেষ দুটা পাতা গাড়িতে বসে পড়েছেন।
জালাল খাঁর বয়স পঞ্চাশ। এই বয়সে মানুষের মাথায় কাঁচাপাকা চুল থাকে। জালাল খাঁর মাথার সব চুল পাকা। টকটকে গৌরবর্ণের একজন মানুষ যার মাথা ভর্তি শরতের মেঘের মতো ধবধবে সাদা চুল। পৃথিবীতে সবচে বেশি সংখ্যক বই পড়েছেন এই সূত্রে মানুষটার নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ যেতে পারত। কিন্তু গিনেস বুকওয়ালাদের এ ধরনের কোনো ক্যাটাগরি নেই।
মাহতাব সাহেব বললেন, তুই কি আইসি এনেছিস?
জালাল খাঁ বললেন, কীসের আইসি?
মাহতাব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কীসের আইসি মানে? তোকে না। বললাম, একজন মানুষকে টেস্ট করা হবে।
জালাল খাঁ বললেন, তোকে তো খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছে। এত উত্তেজিত কেন? এত উত্তেজিত হবার মতো কিছু পৃথিবীতে ঘটে না। এটম বোমা পড়ার ঘটনা এই পৃথিবীতে মাত্র দুবার ঘটেছে।
তোকে আনাই হয়েছে লোকটাকে পরীক্ষা করার জন্যে।
পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষার ব্যবস্থা করা আছে। আমার একটা ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার আছে। নষ্ট হয়ে গেছে। ভয়েস রেকর্ড হয় না। সেটা এনেছি। তোর মিস্ত্রিকে সেটা ঠিক করতে দেয়া হবে। তুই শান্ত হ। ডাক তাকে। তার আগে ব্রিফিং দেলোকটার ব্যাপারটা কী? সে কি ভিলেজ ইডিয়ট?
ভিলেজ ইডিয়ট মানে?
সব গ্রামে একজন থাকে মহানিৰ্বোধ। তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। সে যখন হঠাৎ কিছু বুদ্ধির পরিচয় দেয় তখন হৈচৈ পড়ে যায়। সেরকম না তো?
না, সেরকম না। লোকটা নির্বোধ না। পড়াশোনা কিছুই জানে না। তার। জীবিকা হলো মাটি কাটা।
জালাল খাঁ বললেন, তোর কথা বুঝতে পারছি নালোকটার যদি যন্ত্রপাতি ঠিক করার জাদুকরি ক্ষমতা থাকে তাহলে সে মাটি কাটবে কেন? সে একটা ওয়ার্কশপ দিয়ে দুহাতে টাকা কামাবে। এটা সে কেন করছে না?
মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই ডেকে জিজ্ঞেস কর কেন করছে না।
আমি রহস্যভেদ করতে পারছি না বলেই তোক ডেকেছি।
জালাল খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, জানি না তোর কী হয়েছে। তুই খুবই উত্তেজিত। উত্তেজনায় তোর কথাবার্তাও জড়িয়ে যাচ্ছে। ডাক তোর মিস্ত্রিকে। কথা বলি।
মাহতাব সাহেব বন্ধুকে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে বসলেন। বারেককে পাঠালেন খলিলুল্লাহকে আনতে। বিশেষ করে বলে দিলেন খলিলুল্লাহর সঙ্গে টুনটুনি যেন না আসে। টুনটুনি সারাক্ষণ খলিলুল্লাহর সঙ্গে লেগে আছে—এটা মাহতাব সাহেবের ভালো লাগছে না। লাইব্রেরি ঘরে খলিলুল্লাহর বসার জন্যে একটা টুল রাখা হলো। টুলের সামনে দুটা সোফা। একটিতে মাহতাব সাহেব, অন্যটিতে জালাল খাঁ। রীতিমতো ভাইবা পরীক্ষা।
খলিলুল্লাহকে দেখে মাহতাব উদ্দিন চমকে উঠলেন। এ কে? এ তো খলিলুল্লাহ না। এ অন্য কেউ। কী সুন্দর চেহারা! মুখের চামড়ায় রোদে পোড়া ভাব নেই। মেয়েদের চামড়ার মতো কমনীয় চামড়া। চোখের মণির রঙ নীলাভ। এটা অবশ্যি সবুজ রঙের শার্ট পরার কারণে হতে পারে। সার্টের সবুজ রঙ পড়েছে চোখের মণিতে। আগে লোকটা কুঁজো হয়ে দাঁড়াত, এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকাচ্ছে না। বরং কৌতূহলী চোখে জালাল খাঁকে দেখছে।
জালাল খাঁ বিস্মিত হয়ে চাপা গলায় মাহতাব সাহেবকে বললেন, এই কি তোর সেই খলিলুল্লাহ?
মাহতাব সাহেব বললেন, হুঁ।
মাটি কাটা যার জীবিকা?
হুঁ।
দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না।
মাহতাব সাহেব কিছু না বলে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে লক্ষ করলেন তার হাত কাঁপছে। টেনশনের লক্ষণ। তার ভেতর চাপা টেনশন কাজ করছে। প্রেসার কি আবারো বেড়েছে।
জালাল খাঁ খলিলুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কী?
আমার নাম অরণ্য।
জালাল খাঁ তাকালেন মাহতাব সাহেবের দিকে। মাহতাব সাহেব নিজের মনে সিগারেট টানছেন। খলিলুল্লাহর কথায় তাঁর কোনো ভাবান্তর হলো না।