- বইয়ের নামঃ দ্বিতীয় মানব
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, উপন্যাস
চৈত্র মাসে মানুষের মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে
চৈত্র মাসে মানুষের মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে। ঠাণ্ডা ধরনের মানুষের বেলাতেও দেখা যায়—বোদ চড়তে থাকে, তাদের মেজাজও চড়তে থাকে। সেই হিসাবে মাহতাব উদ্দিন সাহেবের মেজাজ তুঙ্গস্পর্শী হবার কথা। কারণ আজ চৈত্রের তৃতীয় দিবস, সময় দুপুর, ঝাঁঝালো রোদ উঠেছে। এবং মাহতাব সাহেব এমনিতেই রাগী মানুষ। ধমক না দিয়ে কথা বলতে পারেন না।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মাহতাব উদ্দিন সাহেবের মেজাজ ঠাণ্ডা। তিনি প্রায় তিনি প্রায় হাসি-হাসি মুখে বসার ঘরে খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন। তাঁর সামনে টেবিলে চা। টেবিলের ওপাশে বসার ঘরের মাঝামাঝি নীল লুঙ্গি পরা অত্যন্ত বলশালী একটা লোক খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোটার গভর্তি ঘন লোম। বিশাল মুখমণ্ডল। মনে হচ্ছে গত সাতদিন সে দাড়ি কামায়নি। মুখভৰ্তি খোচা খোচা দাড়ি। সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের আঙুলের দিকে।
মাহতাব উদ্দিন লোকটির দৃষ্টি অনুসরণ করে তার পায়ের আঙুলের দিকে তাকালেন। থ্যাবড়া থ্যাবড়া পায়ের মোটা মোটা আঙুল। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল এবং তার পরেরটা সে হারমোনিয়ামের রিডের মতো ওঠানামা করাচ্ছে। মাহতাব উদ্দিন বললেন, তোমার নাম কী?
লোকটা তার পায়ের আঙুলের নাচানাচি দেখতে দেখতে বলল, খলিলুল্লাহ। দশজনে খলিল বইল্যা ডাকে।
তোমার নাম খলিলুল্লাহ?
জ্বে।
খালি গায়ে ঘুরছ কেন?
গরম লাগে।
আমার সামনে থেকে যাও। গেঞ্জি, সার্ট বা ফতুয়া যে-কোনো একটা কিছু গায়ে দিয়ে আসে। কখনো খালি গায়ে থাকবে না। খালি গায়ে বাড়ির ভেতর ঢোকা বিরাট অসভ্যতা। আমার বাড়িতে অসভ্যতা করা যাবে না।
জ্বে আইচ্ছা।
খালি পায়েও থাকবে না। সবসময় স্যান্ডেল পরে থাকবে।
খলিলুল্লাহ বিড়বিড় করে বলল, স্যাভেল নাই।
মাহতাব উদ্দিন বললেন, আপাতত সার্ট গায়ে দিয়ে আসসা। স্যান্ডেল বিষয়ে পরে কথা হবে। জ্বে আইচ্ছা।
রাগে মাহতাব উদ্দিনের গা জ্বলে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি মুখ হাসি-হাসি করে রেখেছেন। কারণ, তিনি তার মেয়ে টুনটুনিকে গতকাল রাত এগারোটায় কথা দিয়েছেন—আগামী সাতদিন তিনি রাগারাগি করবেন না, কাউকে ধমক দেবেন। না, এমনকি কঠিন কথাও হাসিমুখ ছাড়া কখনো বলবেন না।
এই প্ৰতিজ্ঞা রাখা মাহতাব সাহেবের জন্যে অত্যন্ত কঠিন। তিনি অসম্ভব রাগী মানুষ। অল্পতেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়। তাঁর কপালটা এরকম যে মেজাজ খারাপ হবার মতো ঘটনা কিছুক্ষণ পরপর তাঁর চোখের সামনে ঘটে।
আজ ছুটির দিন। তিনি মোটামুটি ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে চা খাচ্ছেন। টুনটুনিকে নিয়ে গুলশানের এক আইসক্রিমের দোকানে যাবেন। ফেরার পথে টুনটুনি বারিধারা থেকে তার দুই বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে আসবে। তিন বান্ধবী ছাদের সুইমিংপুলে লাফালাফি ঝাপঝাপি করবে। সকাল থেকেই সুইমিংপুলে পানি দেয়া হচ্ছে। আনন্দময় ছুটির দিন। এর মধ্যে উপস্থিত হয়েছে খলিলুল্লাহ। চাকরির সন্ধানে মাহতাব সাহেবের দেশের বাড়ি থেকে এসেছে।
চাকরির সন্ধানে দেশ থেকে লোকজন আসাই মেজাজ খারাপ হবার মতো ঘটনা। ঢাকা শহরের পথে-ঘাটে চাকরি পড়ে থাকে না। কেউ এলো, পথ থেকে একটা চাকরি কুড়িয়ে তার হাতে দিয়ে দেয়া হলো, হাসিমুখে চাকরি নিয়ে সে বাড়ি চলে গেল। ঘটনা সেরকম না। বিএ, এমএ পাস ছেলে শুকনা মুখে পথেঘাটে ঘুরছে। চাকরির সন্ধানে দেশ থেকে আসা লোকজনদের মাহতাব সাহেব কঠিন ধমক দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিদায় করেন। খলিলুল্লাহর ব্যাপারে এটা করতে পারছেন না। কারণ, তিনি টুনটুনিকে কথা দিয়েছেন আগামী এক সপ্তাহ কারো সঙ্গে রাগারাগি করবেন না। মুখ হাসি-হাসি করে রাখবেন।
মাহতাব সাহেব মুখ হাসি-হাসি করেই রেখেছেন। প্রচণ্ড রাগ নিয়েও মুখ হাসি-হাসি করে রাখা একটি কষ্টকর প্রক্রিয়া। তাঁকে এই কষ্টকর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। কতক্ষণ যেতে পারবেন সেটা হলো কথা।
খলিলুল্লাহ আবার ঢুকছে। সে লুঙ্গির উপর একটা চকচকে হলুদ সার্ট পরে এসেছে। গলায় মাফলারের মতো ভেজা গামছা পেঁচানো। মাহতাব সাহেব তাকে গলায় গামছা পরতে বলেন নি। মনে হচ্ছে গলায় গামছা পরাটাকে সে সাজসজ্জার অংশ হিসেবে নিয়েছে।
আমার কাছে চাকরির সন্ধানে এসেছ?
খলিলুল্লাহ কিছু বলল না। আগের মতো পায়ের বুড়ো আঙুল ওঠানামা করাতে লাগল। তবে এখন সে দুটো পায়ের বুড়ো আঙুলই নাচাচ্ছে।
দেশের বাড়িতে কী কাজ করতে?
মাটি কাটতাম।
মাটি কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ জানো?
জ্বে না।
মাটি কাটা বন্ধ করে ঢাকায় এসেছ কেন?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। তার দৃষ্টি পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে।
মাহতাব সাহেব বললেন, ঢাকা শহরে মাটি কাটার কাজ নেই। শহরে মাটিই নেই, কাটবে কীভাবে? ঢাকা শহর হলো ইট-সিমেন্টের। ইট-সিমেন্ট কাটতে পারো?
জ্বে না।
তাহলে তো আর করার কিছু নেই। বাড়ি চলে যাও।
জ্বে আইজা। চইল্যা যাব।
মাহতাব সাহেব খুবই বিস্মিত হলেন। বাড়ি চলে যাবার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে ঘাড় কাত করে বলছে-জে আইচ্ছা। এইসব ক্ষেত্রে নানান অনুনয় বিনয় চলে। ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে আছি-এ জাতীয় কথাবার্তা বলা হয়। কেউ এক কথায় বাড়ি চলে যেতে রাজি হয় না।