ট্রেনে জানালার পাশে বসিয়া কাজল সমস্ত রাস্তা ভাবিতে ভাবিতে চলিল। ঠাণ্ডা বাতাসে হাড়ের ভিতর কাঁপন ধরে। গলা বাড়াইলে দেখা যায় কালপুরুষমণ্ডলীর বেটেলজয়ুস নক্ষত্রটা লালচে আভায় ঝকঝক করিতেছে।
কাহারা গোপন ছাউনির নিচে আগুন করিয়া হাত-পা সেঁকিতেছে। হাওয়ায় শীতের ঘ্রাণ, পোড়া ডালপালার ঘ্রাণ। বোমারু বিমানের ভয়ে উন্মুক্ত স্থানে আগুন জ্বালায় নাই।
ট্রেনের এঞ্জিন হইতে বারদুয়েক হুইস্লের শব্দ ভাসিয়া আসিল।
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
গতকাল আমাদের একজন অধ্যাপক না আসায় একটা পিরিয়ড ছুটি পাওয়া গেল। পরমেশ লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিল, তাকে না ডেকে আমি একাই একটু হাঁটছিলাম রাস্তায়।
অন্যমনস্ক ভাবে চলতে চলতে ভেবে দেখলাম, আমার ভেতরে যে দ্বন্দ্বটা চলছে সেটা মোটেই আকস্মিক নয়। ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ একদিন বেরিয়ে পড়েছে। আমার সমস্যা অন্যের কাছে অবাস্তব, কিন্তু আমার কাছে অন্ধকারের ভেতর প্রজ্বলন্ত আগুনের মতো বাস্তব ও প্রত্যক্ষ। চিন্তার একটা বিশেষ ধাপ পর্যন্ত এসে আটকে গেছি আমি, মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারছি না। হয়তো কেউই তা পারে না।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, চলা বন্ধ করে আমি সামনের তেতলা বাড়ির ছাদের ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছি। চোখ নামিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করবো, দেখি রাস্তার ওপারে মিষ্টির দোকানে গোলমাল-বোগামতো একটা লোকের ঘাড় ধরে বিশালদেহ দোকানদার ঝাকুনি দিচ্ছে, আর একজন তার কাপড়চোপড়ের ভেতর হাতড়ে কী খুঁজছে। রোগা লোকটি হাতজোড় করে কী বলতে গেল—দোকানদার মারল তাকে এক রদ্দা, ছিটকে সে ফুটপাথে গিয়ে পড়ল।
ভারি খারাপ লাগল ব্যাপারটা। হাত জোড় কবে লোকটা কী বলতে চাইছে, কেউ শুনছে না। রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গেলাম—ততক্ষণে সে এক হাতে ভর দিয়ে উঠে বসেছে। থমকে গেলাম আমি, দেখলাম লোকটি রামদাস বৈষ্ণব। রামদাস বৈষ্ণবকে এরা মারছে।
-রামদাস কাকা!
রামদাস চমকে আমার দিকে তাকাল। কী চেহারা হয়ে গিয়েছে তার। চোখের নিচে গভীর কালি, চুল লালচে, উস্কোখুস্কো। শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। মারের চোটে এখনও সে অল্প অল্প কাপছে।
রামদাস আমায় চিনতে পেরেছে। পুরোনো দিনের মতোই খুশি-খুশি গলায় বলে উঠলো বাবাজী, তুমি!
দোকানদার এবং তার দুই সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী হয়েছে? আপনারা মারছেন কেন একে?
দোকানদার খিচিয়ে উঠল—মারবে না তো কি সিংহাসনে বসিয়ে পুজো করবে? চারআনার জিলিপি খেয়ে এখন বলছে পয়সা নেই! শালা ইয়ের বাচ্চা–
ইতর কথা এবং তাদের মুখচোখের ইতর ভাব দেখে আমার এত খারাপ লাগলো! বললাম–বৈষ্ণবকে মারতে হাত উঠলো আপনার? আবার গালগালও দিচ্ছেন–
-যান যান মশাই, অমন অনেক বোষ্টম দেখেছি। ভেক নিলেই বোষ্টম হয় না, ওসব লোক ঠকাবার ফন্দি–
রামদাসকে জিজ্ঞাসা করলাম–কী হয়েছে রামদাস কাকা?
রামদাস তখন দাঁড়িয়ে উঠেছে। বলল–গেঁজেতে পয়সা রেখেছিলাম। কখন পড়ে গেছে বুঝতে পারিনি। সারাদিন ঘুরছি তো রাস্তায় রাস্তায়। তুমি তো জানো বাবাজী, পয়সা নেই জানলে আমি একদানাও মুখে দিতাম না এখানে–
দোকানদারের লোক বলল—ওরে আমার ধার্মিক যুধিষ্ঠির রে!
তাকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-কত পয়সা আপনাদের? চার আনা? এই নিন, ছেড়ে দিন একে। চলো রামদাস কাকা–
রামদাস বলল—আমার একটা থলে ওরা রেখে দিয়েছে। একটা দোতারা ছিল সঙ্গে, সেটা ভেঙে দিয়েছে–
দোকানদার ভেতর থেকে দোতারা এবং একটা ছেঁড়া ক্যাম্বিসের থলে এনে দিলে। খানিকদূর এসে দোতারায় হাত বুলিয়ে রামদাস বললো—এটা একদম ভেঙে দিয়েছে বাবাজী। তারগুলো ছিঁড়ে দিয়েছে, আর বাজানো যাবে না
থলের ভেতর হাতড়ে খঞ্জনীটা বের করল সে, হেসে বলল–এটা নেয় নি। যাক, একটা তবু রইলো
খঞ্জনী বাজিয়ে সে তার অভ্যেসমতো হাসলো। বলল—জয় গুরু, জয় গুরু!
-তুমি হাসছ রামদাস কাকা! তোমাকে ওরা অপমান করল, মারল—তার পরেও হাসছো?
–হাসবো না কেন? দুঃখ করার সময় কোথায় আমার?
—ওদের ওপর রাগ হচ্ছে না?
—না বাবাজী, সত্যি বলছি—ওরা যদি বুঝতো খারাপ কাজ, তাহলে কি আর মারত আমাকে? না বুঝে যা করেছে তার জন্য ওদের আমি দোষ দেব না। গুরু ওদের ভালো করুন।
–তুমি বড়ো ভালো মানুষ রামদাস কাকা। আমরা হলে অপমান সইতে পারতাম না।
মার খাওয়াটা যেন ভারি একটা মজার ব্যাপার, রামদাস এমনিভাবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল–একটা কথা তো তোমায় বলা হয়নি বাবাজী, আমার যক্ষ্মা হয়েছে।
যক্ষ্মা রামদাসের! সে কথা এতক্ষণ না বলে দিব্যি হাসছিল সে!
—কী বলছো রামদাস কাকা! যক্ষ্মা?
–হ্যাঁ, বাবাজী। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম কলকাতায়। গাঁয়ের ডাক্তার বললো শহরে গিয়ে দেখাতে। হাসপাতালে হাঁ করে বসেছিলাম সারাদিন, আমার ডাক আসার আগেই ডাক্তারের রুগী দেখার সময় পেরিয়ে গেল। চাপরাসী বলেছে, কাল যেতে। কাল যাব আবার–
–রাত্তিরে থাকবে কোথায়?
—শুয়ে পড়ব রাস্তার ধারে কোথাও কাপড় মুড়ি দিয়ে। রাস্তায় শুলে তো মারবে না।
এই হিমবর্ষী রাতে রামদাস অচেনা শহরের ফুটপাতে শুয়ে থাকবে, খাওয়া মিলবে কিনা ঠিক নেই। তা সত্ত্বেও সে হাসছে।
—তুমি আমার সঙ্গে চলো রামদাস কাকা, আমাদের বাড়ি চলল। আমি তোমায় ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবো।