তখনও শম্ভ পাগলা সমানে চিৎকার করে চলেছে ভাত—ভাত—ভাত!
একদিন মিউজিয়ামে গেলাম। বহুদিন আগে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম, আর এই। সময়ের দিক দিয়ে দেখতে গেলে খুব বেশিদিন নয় কিন্তু আমিই পালটে গেছি।
মিউজিয়ামের ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ঘুম-ঘুম ভাবটা আমার ভালো লাগে। করিডোরের সারি সারি ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি, অল্প আলোয় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর কঙ্কাল, মৃত্তিকাভ্যন্তর থেকে আনা বিচিত্র পাথর— এসবের মধ্যে, আমার মনে হয, কী যেন লুকিয়ে আছে। বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া মানুষের উপস্থিতি আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে অনুভব করতে পারি।
লম্বা ঘরগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকিয়ে মন বাধাবন্ধ মানতে চায় না ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে ফেটে পড়ি। ভূ-বিজ্ঞান প্রত্নতত্ত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে লুকোনো আছে মানুষের জন্মের ইতিহাস। সবকিছু একসঙ্গে না জানতে পেরে খালি মনে হয়, ঠকে গেলাম—বোকা রয়ে গেলাম। একটি ঘরে বৌদ্ধযুগেব মূর্তিশিল্প সংগৃহীত। আমি আইকনোগ্রাফির ধার ধারি না, অথচ কী এক আকর্ষণে আজ ঢুকেছিলাম। ভালোই করেছিলাম, তার ফলে আমার এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হল।
পাথরের এক নারীমূর্তি আমার বড় ভালো লেগে গেল। মূর্তিকারের নাম নেই। শুধু লেখা মূর্তিটি খ্রিস্ট-জন্মের আগে তৈবি, সম্ভবত শিল্পীর প্রেয়সীর প্রতিকৃতি। ঘরের আয়তনের তুলনায় আলো যথেষ্ট নয়। ফলে সব সময়ই কেমন আধো আলো আধো অন্ধকার ভাব ঘরের মধ্যে। সেই মৃদু আলোকিত স্বপ্ন-স্বপ্ন পরিবেশে মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটি হাসছে।
তখন কাছাকাছি কোনো মানুষ ছিল না, খুব কাছে গিয়ে আমি মুখের দিকে তাকালাম। সে হাসি পাথরে উৎকীর্ণ বটে, কিন্তু আমার মনে হল মেয়েটি যেন এইমাত্র আমাকে দেখে হেসে উঠেছে।
আমার সে সময়কার মনের অবস্থা বোঝানো যায় না বলেই তেমন চেষ্টা করছি না। দরকারই বা কী, এ ডায়েরি আমি ছাড়া যখন অন্য কেউ পড়বে না। খালি মনে হতে লাগল, কবে যেন এর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। বহুদিন আগে উপহার পাওয়া আতরের শিশি বাক্স থেকে বার করে শুকলে তার গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে যেমন পুরোনো দিনটা আবার ফিরে আসে, তেমনি ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হল অতীত আমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ধূপের মৃদু গন্ধ পেলাম, প্রাচীন যুগের মহিলারা ধূপের ধোয়ায় চুল শুকোতে বসলে যেমনটি পাওয়া যেতো। অনুভূতি এত তীব্র ও স্পষ্ট যে, আমি নিজেকে সরাসরি সে যুগটার সঙ্গে জড়িত বলে বোধ করলাম।
বাড়ি আসতে মনে হলো আমি এবং সে অস্তিত্ব একই সমতলে অবস্থিত নই–দেশকালের বিভিন্ন দুই স্তরে কবে থেকে আমরা পরস্পরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কোনো এক ধ্রুবকেন্দ্রে এসে মিলিত হতে পারছি না। শুধু খুঁজছি, শুধু খুঁজছি।
কবে যেন সে আমার জন্য কুটিরাঙ্গণে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে থাকত। সে কবেকার ভুলে যাওয়া অতীতের কথা।
সমস্ত মনে কী যেন হারানোর যন্ত্রণা, খুঁজে না পাওয়ার অতৃপ্তি।
১৫. কলেজে যাইবে বলিয়া কাজল
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কলেজে যাইবে বলিয়া কাজল বইপত্র গোছাইতেছে, হৈমন্তী ডাকিয়া বলিল—হ্যাঁ রে, কলকাতার অবস্থা কেমন? শুনলাম লোকজন নাকি খুব পালাচ্ছে? ভট্টাচার্যপাড়ায় বকুলের বাবার যে বাড়িটা খালি পড়েছিল, সেটায় এক পরিবার এসে উঠেছে। এখানে থাকবে না বলেছে, আরও গায়ের দিকে চলে যাবে।
কাজল বলিল—আমি তো এখন পর্যন্ত ভয়ের কিছু দেখলাম না। লোজন কিছু গাঁয়ের দিকে পালিয়েছে ঠিকই, রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ঠেকে আগের চেয়ে। তবে অফিস কাছারি ঠিকই চলছে
—আমাদের এদিকে ভয়ের কিছু নেই, না?
–দুর! কোথায় রইল যুদ্ধ, কোথায় আমরা! যারা পালিয়েছে তারাও ফিরলো বলে, দেখ না।
একদিন কলেজ হইতে ফিরিবার সময় কাজল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইবার খবর পায়। শেয়ালদূহের মোড়ে খবরের কাগজের হকার হাঁকিতেছে—টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! বহুলোক ভিড় করিয়া পড়িতেছে এবং সরব আলোচনা করিতেছে। একখানা কিনিয়া কাজল পড়িয়া দেখিল। পোলিশ করিডর দাবি করিয়া হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করিয়াছেন। যুদ্ধ শুরু হইয়াছে।
ক্রমে কলিকাতার চেহারা পালটাইল। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কালো ঠুলি পরাইয়া দেওয়া হইল। এ. আর. পি. বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া নাম ধাম লিখিয়া লইতে লাগিল, প্রয়োজনীয় উপদেশ দিতে লাগিল। অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটিতে কাজলের মনে একটা বিশ্রী ভাব যেন চাপিয়া বসিত। শীতকালে সন্ধ্যা হয় বিকাল শেষ হইতে না হইতেই। কলেজ হইতে বাহির হইয়া কাজল দেখিত, বিশাল শহরের উপরে দুঃস্বপ্নের মতো অন্ধকার চাপিয়া বসিতেছে।
মালতীনগরে বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই। কাঠালিয়ার কাছে একটা বিরাট মাঠ সৈন্যেরা কাটাতারে ঘিরিয়া সেখানে রাইফেল প্র্যাকটিস করে। সাধারণের সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
সকালে উঠিয়া শোনা যায়। দূর হইতে রাইফেলের আওয়াজ আসিতেছে। সুন্দর সকাল। জানালার পাশে গিরগাছায় সকালের রোদূর আসিয়া পড়িয়াছে, এটা টুনটুনি পাখি বার বার ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার ডালে আসিয়া বসিতেছে। মিষ্টি আমেজের ভিতর রাইফেলের শব্দে কাজলের মেজাজ খারাপ হইয়া যায়। তাহার জীবনের সহিত বন্দুকের শব্দ মাই খাপ খায় না।