বেঁচে থাকার তবে অর্থ কী? সমস্ত পৃথিবীটার সৃষ্টি না হলেও ক্ষতি ছিল না। আমি তো চিরদিনের জন্য তাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না, তবে সামান্য সময়ের জন্য ধরে রাখার কী অর্থ?
অথচ ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের কী যেন গৃঢ় অর্থ আছে। জীবনের সার্থকতা কোথায়, কে যেন তা আমাকে কানে কানে বলে যায়। আধো ঘুমের মধ্যে আমি হাতুড়ে বিছানায় খুঁজি—যেন সার্থকতার চাবিকাঠি কেউ আমার কাছেই রেখে গেছে। পাই না, হাতে ঠেকে মায়ের গা। শেষ রাত্রের তরল অন্ধকারে হঠাৎ জেগে যাওয়া চোখে মাকে আঁকড়ে শুয়ে থাকি। যেন মাকে ছেড়ে দিলেই আঁধার সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাঙা পানসির মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কোথায়।
আমার স্বভাব বড়ো রুক্ষ হয়ে উঠছে। হয়তো মানসিক অসন্তুষ্টিই এর কারণ। আমি বুঝতে পারি না, সবাই কী করে একে অস্বীকার করে হাসিমুখে বেঁচে আছে। হয় তারা সবাই একযোগে বোকা, নয়তো আমার থেকে অনেক জ্ঞানী। আজকাল বেড়াতে গিয়ে মাঠের মধ্যে জঙ্গলের মধ্যে সব জায়গায় অতৃপ্তি অনুভব করি। কালো পোশাক পরা কে একজন আমার পেছন পেছন আসেতাকে আমি দেখতে পাই না, তাকে অনুভব করি। জানি দিন যত কাটবে, তার আর আমার ব্যবধান ততই কমে আসতে থাকবে।
পরমেশের বোনের শশুরবাড়ি ব্যারাকপুরে। বোনকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিতে সে ব্যারাকপুরে গিয়েছিল, সঙ্গে নিয়েছিল আমাকে। দুপুরবেলা তার ভগ্নীপতির বাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেবে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম। এধারে লোজন কম, কাছেই মিলিটারি ব্যারাক। গঙ্গার পাড়ে বাবলার বন, দূর থেকেই দেখা যায় বাবলাগাছের ফাঁকে ফাঁকে নদীর জল চিকচিক করছে।
উঁচু পাড়ে বসে ওপারে শ্রীরামপুরের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছি, এমনি সময় নজরে পড়ল পাড়ের নিচেই কাদার ওপর পড়ে আছে একটা ছোট কাগজের বাণ্ডিল-নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। কী রকম মনের ভাব হল—জুতো খুলে টপ করে নিচে নামলাম জলের কাছাকাছি। তখন ভাটা চলছে, জল এসে কাগজগুলোকে স্পর্শ করেনি। যে ফেলেছে, কিছুক্ষণ আগেও সে এখানে ছিল।
সুতোটা না খুলে ভাববার চেষ্টা করলাম, এগুলো কী হতে পারে। বাজে কাগজ? দলিল? বাড়িভাড়ার পুরোনো রসিদ? প্রেমপত্র?
খুলে দেখি প্রেমপত্রই বটে। ঘটনাটা উপন্যাসের মতো শোনাচ্ছে—ডায়েরির ছেঁড়া পাতায় কাঁচা হাতের লেখায় ভুল বানানে প্রায় পনেরো-কুড়িটি প্রেমপত্র নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। যাকে লেখা, তার জীবনে হয়তো এগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এতদিন সযত্নে রাখা ছিল বাক্সের কোণে, বেব করে আজ গঙ্গার বুকে ফেলে দিয়ে গেছে।
চিঠিগুলো তখন পড়িনি। বাড়ি এসে পড়বার ঘরে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে এক-একখানা করে পড়ে ফেললাম। নাম দেওয়া নেই। তবে এটুকু বোঝা যায় কোনো মেয়ে তার প্রেমিককে উদ্দেশ করে চিঠিগুলি লিখেছিল। চিঠির নিচে লেখা—’ইতি তোমার মিতা’। সম্বোধনেও প্রাণের মিতা। কাজেই মিতা তার নাম নয়। এদের ভালোবাসা পরিণতি লাভ করেনি, চিঠি ফেলে দেওয়া থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। একটিতে লেখা—তোমাকে অনেকদিন পর দেখলাম। মনটা আনতে নেচে উঠলো। সত্যি, আজ সকাল থেকে দিনটা খুব ভালো যাচ্ছে। তোমার কাছ থেকে যা আশা করেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমাকে সারাজীবন যেন এমনি করেই পাই। ইতি—তোমার মিতা। আর একটিতে—তুমি চলে গেলে, কিন্তু একবারও তো বললে না—যাচ্ছি। হয়তো ভুল হয়ে গেছে, হয়তো তুমি দেখো নি, দরজার পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তোমার পছন্দসই সেই ডুরে শাড়িটা পরে। আমার এক বন্ধু বলেছিল ভালোবাসলে দুঃখ পেতে হয়। আমার ভাগ্যে তাই আছে। সারাজীবন হয়তো কেবল দুঃখই পাবো। কেন যে এমন ভুল করলাম। ইতি—তোমার অবুঝ মিতা।
অন্য কেউ পড়লে হয়তো মনে মনে বিরাট এক গল্প তৈরি করে নায়িকার দুঃখে সন্ধেটা মুহ্যমান হয়ে কাটাতো। একবছর আগে চিঠিগুলো পড়লে আমিই অচেনা মেয়েটির কথা ভেবে ঘন্টা দুই কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার মনে এক উলটো প্রতিক্রিয়া হল। বাইরে থেকে বাতাস এসে বারবার টেবিল ল্যাম্পের আলো কঁপিয়ে দিয়ে দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের পাতা নিয়ে খেলা করছে, বাড়ির সামনে শম্ভ পাগলা এসে প্রতিদিনের মতো খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ তুলে টানা সুরে বলে যাচ্ছে-ভাত খাবো, ভাত খাবো, ভাত—ভাত-ভাত! পাশের বাড়ির ছাদে কে যেন দুমদুম করে কয়লা ভাঙছে। এর মধ্যে আমার মনে বিচিত্র অসন্তোষের ঝড়। চিঠিগুলোর প্রেরক এবং প্রাপককে যেমন আমি কোনোদিনই জানতে পারবো না, তেমনি আমার প্রশ্নের উত্তরও আমি কোনদিন পাবো না। আমার অস্থিরতার সঙ্গে চিঠির ব্যাপারটা হঠাৎ মিলেমিশে এক হয়ে গেল। বাতি নিভিয়ে দিতেই তারাদের ছায়া নিয়ে একরাশ জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপরে। বাতাস বাইরের গাছগুলোকে ধবে খুব করে এক-একবার ঝাকিয়ে দিয়ে গেল। বাতিটা থেকে পোড়া সলতের কেমন একটা গন্ধ আসছে, নামিয়ে রাখতে গিয়ে নজবে পড়লো মেঝেয় জ্যোৎস্নার ফালি। আমার মাথার ভেতরে চেতনাটা অতীতকে ভালোবাসে, নাম-না-জানা ফুলের গন্ধে ভারাক্রান্ত অতীতের সন্ধেগুলোয় ফিরে যেতে চায়—সেই চেতনা শেকল ছিঁড়ে হঠাৎ লাফালাফি শুরু কবে দিল। চাদের আলোটুকুর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম একশো বছর আগেকার স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের কথা, যেমনটি পড়েছি বই-এ। সে জীবনের সঙ্গে তুলনা কবে বর্তমানে ওপর আমার বিতৃষ্ণা হল, অসন্তুষ্টি বেড়ে উঠে মনে হতে লাগলো—পাই নি, পাবো না।