-তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো বাবা?
মাথা নাড়িয়া সুরপতি সায় দিলেন। হৈমন্তী মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে, এমন সময় সুরপতি হঠাৎ বলিলেন–দাদু কই?
কাজল কলেজে গিয়েছে বাবা।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সুরপতি বলিলেন–হৈম, দাদু খুব বড়ো হবে, দেখে নিস। ও অন্য রকম–
-তুমি ঘুমোও বাবা, কথা বোলো না–
–আমি বলে গেলাম হৈম, তুই মিলিয়ে নিস!
একটু পরে সুরপতি বলিলেন–গায়ে চাদর দিয়ে দে, আমার শীত করছে।
একদিন মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া কাজল শুনিল, পাশের ঘর হইতে দাদুর ক্ষীণ গলার স্বর ভাসিয়া আসিতেছে। দাদু কী বলিতেছেন, কেহ উত্তর দিতেছে না।
মশারি তুলিয়া কাজল সুরপতির ঘরে গিয়ে দাঁড়াইল। প্রথম রাত্রে সরযূর জাগিয়া থাকার কথা, অতিরিক্ত ক্লান্তিতে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। পরপর কয়েক রাত্রি জাগিয়া দিদিমাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কোথাও কেহ নাই, সমস্ত বাড়িতে অপার্থিব নীরবতা খাঁ-খা করিতেছে।
সুরপতির মাথা বালিশ হইতে নিচে বিছানার চাদরে গড়াইয়া পড়িয়াছে। মাথা তুলিবার বার বার চেষ্টা করিয়াও পারিতেছেন না। কাজলকে দেখিয়া বলিলেন-মাথাটা তুই বালিশে তুলে দিয়ে যা দাদু, কেউ তো আসছে না।
কাজলের বড়ো খারাপ লাগিল। জীবনের পরিণতি যদি এমন হয়, তবে মানুষ বাঁচে কীসের আশায়! যৌবন অতিক্রান্ত হইবার আগেই তো আত্মহত্যা করা উচিত পরবর্তী দুর্দশার হাত হইতে রেহাই পাইবার জন্য।
পরের দিন সকালে সুরেশ ডাক্তার বলিলেন, দিন কাটে কিনা সন্দেহ। কাজল কলেজ এবং প্রতাপ অফিস কামাই করিয়া বাড়িতে থাকিয়া গেল। দুপুরে অনেক মাছ রান্না হইয়াছিল-সরযূ আর হৈমন্তী পরামর্শ করিয়া কাজটা করিয়াছিল। অন্য দিন হইতে বেশি মাছ দেখিয়া দিদিমা বলিলেন— এত মাছ কেন রে?
সরযূ বলিল–খাও না মা। সস্তা পেয়ে প্রতাপ নিয়ে এসেছে।
দিদিমা হাঁটুর ওপর মাথা রাখিয়া দিতে লাগিলেন—আমাকে তোরা সবাই কেন ঠকাচ্ছিস, আসল কথাটা কেন বলছিস নে?
কিছুতেই তাঁহাকে খাওয়ানো গেল না।
দুপুরবেলা সুরপতির শ্বাসকষ্ট ভীষণ বাড়িল। এক-একবার দম লইবার সময় মনে হইতেছিল, প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে।
হৈমন্তী কাজলকে বলিল—একবার তুই চট করে সুরেশবাবুর কাছে যা, তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবি অবস্থাটা বলে—
গায়ে একটা জামা গলাইয়া কাজল সুরপতির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সুরপতি তাকাইয়া আছেন, কিন্তু চিনিতে পারিতেছেন কিনা কাজল বুঝিল না। সে ঝুঁকিয়া বলিল—দাদু, আমি কাজল।
সুরপতি কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিলেন। বুকটা হাপরের মতো সমানে ওঠা-পড়া করিতেছে। গোঙানির স্বরে সুরপতি বলিলেন—দা বুকে বড়ো কষ্ট
দাদুর আর্তস্বর কাজলের ভীষণ খারাপ লাগিল, সে দৌড়াইল সুরেশবাবুর বাড়িতে। রিকশা করিয়া সুরেশবাবুর সঙ্গে ফিরিবার সময় দেখিল প্রতাপ খালি পায়ে বাহির হইতেছে। তাহাদের দেখিয়া বলিল—বাবা মারা গেছেন ডাক্তারবাবু।
ডাক্তারবাবুর ঘড়িতে তখন তিনটা বাজিয়া পাঁচ মিনিট। কুড়ি মিনিট আগেও কাজল দাদুর সহিত কথা বলিয়াছে।
সুরপতির সঙ্গে দেওয়ার জন্য কাজল পাঞ্জাবি কিনিতে গিয়াছে, একটা নামাবলী কিনিতে হইবে। পাড়ার ছেলেরা ফুলের মালা ধূপকাঠি ইত্যাদির জোগাড় করিয়া ফেলিয়াছে। দোকানী রেডিমেড পাঞ্জাবির স্তূপ সামনে আনিয়া বলিল, কী মাপের চাই?
কাজলের শুনিয়া অদ্ভুত লাগিল। গলা পরিষ্কার করিয়া সে বলিল—মাপের দরকার নেই, মাঝারি দেখে দিন। যার জন্যে যাচ্ছে, তিনি মারা গেছেন।
দোকানীর এই মাপ জানিতে চাওয়ার কথা কাজলের বহুদিন মনে ছিল।
দাহ অন্তে লোহা এবং আগুন স্পর্শ করিবার জন্য শ্মশানবন্ধুরা বাড়িতে ঢুকিতেই দিদিমা অনেকদিন বাদে কাঁদিয়া উঠিলেন—ওরে, তোরা কোথায় শীতের মধ্যে রেখে এলি বুড়োকে–ও যে মোটে একলা থাকতে পারে না–
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
এখন অনেক রাত। সবাই ঘুমুচ্ছে, আমার পোষা বেড়ালটাও গুঁড়িসুড়ি মেরে মা’র ট্রাঙ্কের ওপর শুয়ে আছে। বহু দূরের রেলওয়ে সাইডিং থেকে শান্টিং-এর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পাশের বাড়ির মুকুলবাবুর পোষা কুকুরটা ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখে গরগর করে উঠছে।
আমার কেন ভালো লাগছে না, জানি না। দাদু মারা যাবার পর থেকেই কেমন একটা চিন্তার পোকা মাথার ভেতরের সুস্থ কোষগুলি কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যুর পর আমার চিন্তাশক্তি বেশ কিছুদিন অবশ হয়ে ছিল, তাছাড়া আমার বয়সও তখন ছিল কম। কিন্তু দাদুর মৃত্যু আমি খুব কাছ থেকে দেখলাম, মৃত্যুর কালো পোশাক পরা অতিলৌকিক শরীরটা একেবারে আমার গা ছুঁয়ে গেল। সে চলে গেল বটে, কিন্তু তার ক্ষণিক উপস্থিতির নিদারুণ মুহূর্তগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
পাশের ঘরের দরজা খোলা। এ ঘরে এই একমাস আগেও দাদু শুয়ে থাকতেন। আলো পছন্দ করতেন না। বিশ্রামের সময় আলো নেভানো থাকতো। অন্ধকারে দাদুর সিগাবেটের আগুন দেখতে পেতাম। গরমকালে দাদু হাত-পা নাড়তে নাড়তে আপনমনে গাইতেন—ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এ কথা জানবার জন্য সন্ন্যাসী হওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু মৃত্যু এসে একদিন সব কেড়ে নিয়ে বিষাণ বাজাতে বাজাতে চলে যাবে—এটা সহ্য করতে হলে দৃঢ় মন দরকার। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি, আমার সে শক্তি নেই। মৃত্যু এসে অলক্ষ্যে আমার ঘরে দাঁড়াবে, তর্জনী তুলে ইঙ্গিত করে কঠিন আদেশ উচ্চারণ করবে—এসো। আমাকে চলে যেতে হবে। আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি, জীবনকে শীতের রোদুরের মতো ভালোবাসি। বৃষ্টির দিনে জানালায় বসে ক্রমঘনায়মান অন্ধকারে অবিশ্রাম বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার মনে হয়, মাটির পৃথিবী হয় ঋতু সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত বর্ষণকান্ত আকাশের ময়ূরকণ্ঠী রঙ-এসব ছেড়ে কখনও আমি যেতে পারবো না। কবিতা লিখি না কিন্তু আমি কবি, আমি রসিক। মাটির সঙ্গে যে নাড়ীর বন্ধন, তাকে ছিঁড়ে যেতে আমি পারবো না। অথচ সে আমার কথা শুনবে না। সে আমায় ছেড়ে যাবে না, প্রতিজ্ঞা শুনে নিঃশব্দে অহাস্য করে দিকচিহীন অন্ধকারে আমাকে চিরকালের জন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।