শীতের শেষে সুরপতি অসুখে পড়িলেন। শরীর খুবই মজবুত ছিল, বাগানের প্রিয় গাছগুলিতে নিজের হাতে পাম্প করিয়া জল তুলিয়া দিতেন। প্রত্যহ কয়েক মাইল হাঁটাহাঁটি চাকবিজীবনের অভ্যাসের মধ্যেই ছিল। তবুও কোন এক রন্ধ্রপথে দেহে অসুখ ঢুকিয়া পড়িল। অসুখ সুরপতি গ্ৰাহেব মধ্যে আনিতেন না, জ্বরজারি হইলে তিনি আরও বেশি ঘোরাঘুরি করিতেন। মনে ভয় ছিল, শুইলেই অসুখ তাহাকে কাবু করিয়া ফেলিবে। কাজল দাদুকে কখনও কোন কারণে শুইয়া থাকিতে দেখে নাই। একদিন কলেজ হইতে ফিরিয়া সন্ধ্যাবেলা সুরপতিকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া সে অবাক হইল। পাশে সরযূ বসিয়া হাওয়া করিতেছে, বাড়িতে থমথমে আরহাওয়া।
হৈমন্তী বলিল–জ্বরটা হঠাৎ বেড়েছে বুড়ো। দুপুরের দিকে আমায় ডেকে বললেন গায়ের ওপর চাদরটা এনে দিতে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, বুকে খুব সর্দি। তুই খেয়ে নে, কী দরকার পড়ে কখন–
কাজল খাইতেছে, দিদিমা আসিয়া বলিলেন—খোকা, তুই খেয়ে সুরেশ ডাক্তারকে একটা খবর দিয়ে আসিস তো, তোর দাদুকে যেন দেখে যায়।
অসুখটা যে বেশি তাহাতে সন্দেহ নাই। বাড়ির সবাই সে কথা বুঝিতে পারিয়াছে। সুরেশবাবুও অনেকদিন হইতে সাবধান করিতেছিলেন, সিগারেট ছাড়িবার উপদেশ দিয়াৰ্হিলেন। সুরপতি তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই।
সুরেশ ডাক্তার সুরপতিকে দেখিয়া গেলেন। প্রতাপ তাহাকে আগাইয়া দিতে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল—ভয়ের কিছু আছে নাকি ডাক্তারবাবু?
—ভয়ের তো বটেই। অনেক দিনের পোষা লোগ। নিঃশাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি নে। দেখি দুদিন–
সকালে খবরের কাগজ আসিলে সুরপতি আগে পড়িতেন। প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে লাগাইয়া কাগজটা আদ্যোপান্ত পড়িয়া শেষ করিতেন। আজ কয়েক দিন কাগজ আসিয়া তাহার টেবিলে পড়িয়া থাকে, প্রতাপ সময় পাইলে বিকালের দিকে একবার দেখে। কলিকাতায় সে ভালো কাজ করিতেছে কোন একটা সওদাগরী অফিসে, খুব সকালে বাহির হইয়া যায়।
রান্নাবান্নর দিকটা হৈমন্তী দেখে। কাজলের দিদিমা এবং সরযূ সুরপতিকে দেখাশুনা করে। খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামা মিটিয়া গেলে হৈমন্তী আসিয়া বাবার কাছে বসে। সুরপতির শরীরের শক্তি
একেবারে চলিয়া গিয়াছে, মাসাধিক কাল শয্যাগত থাকিয়া বুঝিতে পারিয়াছেন, রোগ কঠিন। হৈমন্তী আসিলে জিজ্ঞাসা করেন—ডাক্তার কী বললে রে?
–ভয় কী বাবা? বলে গেছেন কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
–বলেছে এই কথা?
–নয় তো আমি কি মিথ্যে বলছি?
অসুখ উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিল, কমিবার লক্ষণ নাই। বুকে যেন কে দুই মণ পাথর চাপাইয়া রাখিয়াছে, নিঃশ্বাস লইতে কষ্ট হয়। সুরেশ ডাক্তার নানাভাবে পরীক্ষা করিয়া বুকে টোকা মারিয়া বলিলেন—জল হয়েছে বুকে, ট্যাপ করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এত দুর্বল রোগী! সবাই এখন স্পষ্ট বুঝিয়াছে, সুরপতির আর বিছানা ছাড়িয়া উঠিবার আশা নাই। বোঝেন নাই কেবল সুরপতি নিজে। কঠিন অসুখ হইয়াছে ইহা অনুভব করেন, কিন্তু অসুখটা যে তাহাকে পরপারগামী খেয়ায় তুলিয়া দিয়াছে ইহা বুঝিতে পারেন নাই। দুর্বল গলায় প্রত্যেককে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা কবেন, অবস্থার কিছু উন্নতি দেখিতেছে কিনা।
শেষের দিকে বাঁচিবার আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। অন্য কাহারও কথা বিশ্বাস হইত না, দুপুরবেলা হৈমন্তী আসিয়া বসিলে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিতেন—হৈম, সত্যি বল। আমার কাছে লুকোস নে—আমি বাঁচবো তো?
কাজলের যেন কেমন লাগিল। দাদু ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, পরলোকে বিশ্বাস করেন, পুনর্জন্মের স্বপক্ষে অনেক কথা কাজলকে বলিয়াছেন, অথচ পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতে তিনি এত কাতর কেন?
বিছানার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছেন সুরপতি—দুই মাস আগে যাহারা দেখিয়াছে, এখন দেখিলে তাহারা চিনতে পারিবে না। চোখ.কোটরে ঢুকিয়া গিয়াছে, হাড়ের উপর চামড়াটা কোনমতে লাগিয়া আছে মাত্র। নিঃশ্বাস লইবার সময়ে পাঁজরাগুলি প্রকট হইয়া ওঠে।
দিদিমা সমস্ত জীবন দাদুর দেখাশোনা করিয়াছেন। খাইতে বসিলে পাশে বসিয়া হাওয়া করিয়াছেন। শীতকালে আদা-চা এবং গরমকালে বেলের পানা করিয়া দিয়াছেন, বোম ছিড়িয়া গেলে লাগাইয়া দিয়াছেন। কাজল বোঝে এখন দিদিমা অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। অথচ তাহাকে পরিষ্কার করিয়া কেহ কিছু বলে না। সকলের মুখের দিকে তিনি শঙ্কিতভাবে তাকান–যেটা তাহারা গোপন করিতেছে, মুখভাব হইতে সেটা বুঝিবার চেষ্টা করেন।
ডাক্তার একদিন বলিলেন—আর ভরসা দিতে পারছি না, আপনারা প্রস্তুত থাকুন।
প্রস্তুত সকলেই। সুরপতি মানুষ চিনিতে পারিতেছেন না। কষ্ট করিয়া শ্বাস লইবার সময় মুখ দিয়া হা-হা শব্দ হইতেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, অর্থহীন। দুপুরে সবাইকে বিশ্রাম করিতে পাঠাইয়া হৈমন্তী বাবার কাছে বসিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। অপুর মৃত্যুর পর সুরপতি বিরাট মহীরুহের নিচে তাহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন, সে আশ্রয় এইবার নষ্ট হইতে চলিল।
সুরপতি তাকাইয়া চিনিবার চেষ্টা করিলেন। বলিলেন—কে? হৈম?
-হ্যাঁ বাবা, আমি।
সুরপতির কথা বলিতে কষ্ট হইতেছিল, অস্বাভাবিক স্বরে বলিলেন-কাঁদিস নে, তোদর কান্না দেখলে আমি মনে জোর পাই নে।
কান্নার বেগটা হৈমন্তী জোর করিয়া দমন করিল।