কটক ছেড়ে কেয়াঝোপ দেখতে দেখতে চললাম। লাইনের দুদিক কেয়াঝোপে সবুজ হয়ে আছে। মনের মধ্যে উচ্চগ্রামে মাদল বাজছে যেন, একটু পরেই জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখবো।
ট্রেন মালতীপাতপুর ছাড়াল, সামনে পুরী। কী সুন্দর নামটা-মালতীপাতপুর!
দু হাত পেছনে রেখে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল বাবার কথা। অনেকদিন আগে, আমি তখন ছোট, বাবা এসেছিল পুরীতে মাকে নিয়ে। বেলাভূমিতে বাবার পায়ের ছাপ কবে মুছে গেছে ঢেউ-এর অক্লান্ত তাড়নায় কিন্তু তবু মনে হচ্ছে, পুরীর বাতাসে যেন বাবার গায়ের গন্ধ– ছোটবেলায় বাবার বুকে মুখ গুঁজে থাকলে যেমন পেতাম।
মৌপাহাড়িতে বিস্তৃত প্রান্তর দেখেছি, কিন্তু বিস্তৃতি যে কতদূর প্রসারলাভ করতে পারে তা আজ বুঝলাম। ভালো লাগছে বলার চেয়ে কষ্ট হচ্ছে বলাই বেশি সঙ্গত, কারণ সমস্ত সমুদ্রটা আমি একসঙ্গে বুকের ভেতর পুরে নিতে পারছি না। এত বিশালকে একই সঙ্গে সমস্ত দিক দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। ভীষণ ছটফট করছি, কিছুতেই একজায়গায় মন বসাতে পারছি না। সমুদ্র যেন ক্রমশঃ রক্তের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। প্রাণের স্পন্দন প্রথম জেগেছিল জলে। সূর্যের অনুকূল উত্তাপে প্রথম এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি সমুদ্রের বুকে। সমুদ্র জীবনের ধাত্রী। জীবনসৃষ্টির কোটি কোটি বছর আগেও এই সমুদ্র এইরকম অশান্ত হয়ে ঝাপাঝাপি করত বেলাভূমিতে। অন্য সব কিছু থেকে সমুদ্র অনেক বেশি অভিজ্ঞ-বহুদর্শী। অন্ধকার ঢেউ-এর মাথায় মাঝে মাঝে স্বতঃপ্রভ আলো। দিনরাত ভীষণ শব্দ করে সমুদ্র যে কী একটা জানাতে চাইছে, আমি তার ভাষা বুঝতে পারছি না। বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিল। এখন বেঁচে থাকলে বাবার কাছ থেকে জেনে নিতাম।
মানুষ বড়ো অসহায়, তার বলবার কথা সে কিছুতেই গুছিয়ে বলতে পারে না। সামনে ওই elemental fury দেখে মনে একটা আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সমস্ত বিশ্বটার মধ্যে যে একটা master plan আছে সেটা সমুদ্রের মতোই বিশাল, অতিমানবিক। কী রহস্য লুকিয়ে আছে আকাশে-মাটিতেজলে-জীবনে! দর্শনগ্রন্থের সামনে সদ্য অক্ষরপরিচয়প্রাপ্ত শিশুর মতো আমাকে এই বিশালত্বের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
একটা জিনিস আমি বুঝেছি, আমার জীবনটা অন্যান্য মানুষের চেয়ে একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে যেদিন থেকে চিন্তা করতে শিখেছি, সেদিন থেকে আমার ভেতরে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের বীজ একই সঙ্গে উপ্ত হয়েছে। চিন্তা দিয়ে আমার নিজের জন্য একটা ভিন্নতর জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু চিন্তা আমাকে আলোর পথ দেখাতে পারছে না, শুধুমাত্র একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করছে। মুক্তি চাইলেও পাবে না—যে চিন্তাশীল, তার মুক্তি নেই। বন্ধুরা আমার সান্নিধ্য থেকে আর যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছে না। তারা যেভাবে আনন্দ ভোগ করতে চায়, তা আমার আনন্দের ধারণা থেকে আলাদা। ফলে আমি অনেক মানুষের মধ্যেও একা বোধ করি। চেনা মুখের ভিড়ে একলা থাকা বড়ো কষ্টের। আমি প্রাণপণে চাইছি ওদের সবার সঙ্গে ওদের মতো হয়ে মিশে যেতে, ওদের মতো ভাবতে, কথা বলতে। প্রত্যেকবারই কে পেছন থেকে টানছে, বলছে-হবেনা, আর তা হয় না। বাবার সহজ আনন্দটা আমার মধ্যে কমে আসছে, আমি শুধু চিন্তার কঠিন মাটিতে খালি পায়ে হাঁটছি।
কোনারক।
বন্ধুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিকওদিক, আমি চুপ করে বসে আছি। সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া এসে প্রাঙ্গণের ধুলো ওড়াচ্ছে। নোনা বাতাসে মন্দিরের গায়ে উত্তীর্ণ ভাস্কর্য দিন দিন ক্ষয়ে আসছে। বন্ধুদের গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, দূর থেকে ভেসে আসছে কানে। কী নিয়ে যেন ওরা খুব হাসাহাসি করছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের চাতালে একটা কোণায় বসে আছি। এখানটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন, কাছেপিঠে লোকজন নেই। মনে হয় শব্দের জগৎ থেকে আমি নির্বাসিত। বন্ধুরাও হাসি থামিয়েছে।
আমার ডানদিকে পাথরে উৎকীর্ণ একটা পদ্ম। তাতে কনুই রেখে ওপরে তাকিয়ে দেখলাম মন্দিরের চুড়ার কাছে দুই পাথরের দেওয়ালের ফাঁকে নীল আকাশ ঝকঝক করছে। ফাঁকটা দিয়ে একটুকরো সাদা মেঘ ত্বরিত গতিতে ভেসে গেল।
হঠাৎ দেখলাম, আমার মনে সেই বিশেষ ভাবটা জাগছে—বিপুলগড়ের শিব-মন্দিরে যেমন হয়েছিল। ইতিহাস যেন চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। বহু শতাব্দী আগে যখন রোজ পুজো হতো, পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যেতো, সেই আগেকার দিনগুলোকে বড্ড ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে। আমার কাছে বর্তমান যেমন সত্য, উঠোনের ওই ধুলোর ঘূর্ণি যেমন সত্য—সেই সব অতীতের মানুষদের কাছেও তাদের বর্তমান তেমনই সত্য ছিল। কিছুই আমরা চিরদিন আঁকড়ে থাকতে পারি না। সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যাস্তের বং সব কিছু একদিন আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে।
পরমেশ ফিরে আসছে।
-কী রে অমিতাভ, আমাদের সঙ্গে না থেকে বড়ো যে এখানে একলা বসে আছিস?
কী-ই বা উত্তর আমি দিই? উঠে বললাম—চল, তোদের সঙ্গে যাই।
যেতে যেতে ওপরে তাকিয়ে চোখ-ধাঁধানো সূর্যটা দেখে মনে হলো, বছরের পর বছর ধরে সূর্য কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তি পর্যন্ত এইরকম ভাবে পরিক্রমা করবে, সমুদ্রে একবার জোয়ার একবার ভাটা আসবে। আমাদের স্মৃতিটুকুও উত্তরপুরুষদের মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে—কেবল মাথা তুলে সুর্যমন্দিরটা দাঁড়িয়ে থাকবে আরও অনেক শতাব্দী।
১৪. শীতের শেষে সুরপতি অসুখে পড়িলেন
চর্তুদশ পরিচ্ছেদ