একটা খাতায় দুইটি গল্প লিখি সে বন্ধুদের পড়াইয়াছিল। কলেজের বন্ধুদেব (মনেব মিল বেশি না থাকা সত্ত্বেও দুই-একটি বন্ধু তাহার হইয়াছে) মধ্যে অনেকেই তাহার বাবাব ভক্ত। তাহারা গল্প দুইটা আদ্যোপান্ত শুনিয়া বলিল–ভালোই হয়েছে, মন্দ কী! তবে ব্যাপার কী জানো, লেখার মধ্যে তোমার বাবার প্রভাব বড্ড বেশি।
কাজল মহা হাঙ্গামায় পড়িয়াছে। সে ইচ্ছা করিয়া বাবার বই দেখিয়া নকল করিতেছে না। তাহার চিন্তাধারার সহিত বাবার চিন্তাধারা মিলিয়া গেলে সে কী করিতে পারে?
প্রকাণ্ড মাঠের অর্ধেক পার হইয়াছে—এমন সময় কাজল দেখিল, কিছুদূরে মাঠের ভিতর বসিয়া কাহারা আগুন পোহাইতেছে। বেশ দৃশ্যটা। চারিদিকে শূন্য মাঠ, উপরে খোলা আকাশ, তাহার নিচে বসিয়া খড়-বিচালি জ্বালাইয়া কেমন আগুন পোহাইতেছে লোকগুলি। কীসের আকর্ষণে সে পায়ে পায়ে আগাইয়া গিয়া অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়াইল।
লোকগুলি দরিদ্র। এই ভয়ানক শীতে গায়ে একটা করিয়া সূতির জামা। তাহারা গায়ে গায়ে ঘেঁষিয়া হাত আগুনের উপর ছড়াইয়া নিজেদের মধ্যে কী গল্প করিতেছিল। কাজল আসিয়া দাঁড়াইতে লোকগুলি অবাক হইয়া তাহার দিকে তাকাইল। কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে কাজল অপ্রস্তুত বোধ করিয়া বলিল—আগুন পোহাচ্ছেন বুঝি?
অবান্তর প্রশ্ন। শীতের রাতে আগুন জ্বালাইয়া তাহার উপর হাত ছড়াইয়া অতগুলি লোক আগুন পোহানো ছাড়া অন্য কী করিতে পারে?
একজন বলিল–হ্যাঁ বাবা, আপনি বুঝি শহরে থাকেন? এই বুধো, সরে যা ওদিকে। বসুন বাবু ওইখেনটায়, আগুনের কাছে এসে বসুন।
বুধো তাহাকে সম্মান দেখাইয়া সরিয়া বসিল, কিন্তু বাকি কয়জন কেমন আড়ষ্টভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। তাহাদের চোখে শুধু বিস্ময় নহে, একটু যেন আতঙ্কও মিশ্রিত আছে।
প্রথম লোকটি বলিল—এই বুধেই গল্প বলছিল বাবু। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরবার সময় মাঠের মধ্যে ওকে এলে-ভূতে পেয়েছিল। এলে-ভূত জানেন তো? মাঠের মধ্যে পথ ভুলিয়ে লোককে দুরে বেজায়গায় টেনে নিয়ে যায়, তারপর মেরে ফেলে। তা বুধো সন্ধেবেলা বেরিয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে, আর ভূত লেগেছে তার পেছনে–
একজন অনুচ্চকণ্ঠে বলিল–নাম করিস্ না রাত্তিরে—
গল্পটা দীর্ঘ। কাজলকে সবটা শুনিতে হইল-কী করিয়া কাপড়টা ঝাড়িয়া উলটাইয়া পরিয়া তবে বুধো ভূতের হাত হইতে রক্ষা পায়। শুনিতে শুনিতে অনেকে পিঠের উপর দিয়া পিছনের মাঠের দিকে তাকাইয়া দেখিতেছিল। এবং ক্রমাগত আগুনের কাছে অগ্রসর হইতেছিল। ইহাদের আতঙ্কের কারণ এইবার কাজল বুঝিল। অন্ধকার মাঠে বসিয়া প্রেতযোনির গল্প হইতেছিল-রীতিমত গাশিরশির-করা পরিবেশ। এমনি সময় মাঠের ভিতর হইতে আচমকা কাজলের নিঃশব্দ আবির্ভাব। প্রথমটা তাহারা বেজায় চমকাইয়াছিল, আগুনের আলোয় কাজলের ছায়া পড়িতেছে ইহা না দেখা পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়িতে পারে নাই।
ঠাণ্ডা ক্রমশ বাড়িতেছে। তাহারা আরও কাঠকুটা আনিয়া আগুনের মধ্যে ফেলিয়া দিল। শুকনা ডালপালা পুড়িবার পটপট শব্দ উঠিতেছে, বাতাসে পোড়া পাতার গন্ধ। হাত বাড়াইয়া আগুনের উত্তাপ উপভোগ করিতে করিতে কাজলের মনে হইল, এই লোকগুলি তাহার ভারি আপন।
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
আমার ডায়েরি লেখার অভ্যেস মোটেই পুরোনো নয়। ছোটবেলায় কিছুদিন লিখেছিলাম বটে, কিন্তু সে বাবাকে দেখে শখ করে। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে আমার এ বয়সটা একটা বেকর্ড বাখা দরকার—যাতে পরবর্তী সময়ে এর থেকে মানসিক প্রগতির হারটা ধরতে পারি।
কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে পুরী থেকে ঘুরে এলাম। কলেজে প্রথমে খুব খারাপ লাগছিল। পরে তিন-চার জন ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, যাদের সঙ্গে এখন বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। তারাই উদ্যোগ করে বেড়াতে যাবার আয়োজন করলে আমি তাদের সঙ্গী হয়ে পড়লাম।
মার এখনও ধারণা, আমি সেই ছেলেমানুষই আছি। ঘুমোলে আমার গায়ে চাদর টেনে দেন—সকালে উঠে টের পাই। তাছাড়া আমার বইপত্র গুছিয়ে রাখা, কলেজে বেরুনোর সময়ে কলম পেনসিল খুঁজে দেওয়া, এসব তাকেই করতে হয়। কাজেই স্বনির্ভরতার পথে খুব একটা এগিয়ে গেছি—এমন বলা চলে না। মার চোখে হোটই রয়ে গেছি।
আমি, পরমেশ, অমল আর রমানাথ একদিন সন্ধেবেলা ট্রেনে চেপে বসলাম। সারারাত্তির জেগে বসেছিলাম। ছোট স্টেশনে গাড়ি থামছে না, হুহু কবে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছে। কখনও নদীর ওপর দিয়ে গুম গুম করে ব্রিজ পার হচ্ছে—কখনও নীর অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে দেখছি এঞ্জিন থেকে ভেসে আসা জ্বলন্ত কয়লার কুচি।
সকালে কটক। আমার চোখ রাত্রি জাগরণক্লান্ত। তাকিয়ে দেখলায় অদ্ভুত পোশাক পরা রেলওয়ে পুলিশ প্ল্যাটফর্মে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পরমেশ চা খাওয়ালে সবাইকে। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাড় নিয়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো সত্যিই এক বেড়াতে চলেছি তাহলে। জীবনে কখনও কোথাও একা বেরুই নি।
দুদিন আগে রাত্তিরে স্বপ্নে সমুদ্র দেখেছিলাম। তখন পুরী যাওয়ার কথা চলছে, দেখলাম সমুদ্রের ধারে বালির উপর পায়চারি করছি। হলুদ বালির বেলাভূমি, তার ওপর শ্রেণীবদ্ধ নারকেলগাছ অশান্ত হাওয়ায় থরথর করে কাঁপছে। মাথার ওপরে দীপ্ত সূর্য। ভালো করে দেখতে পাইনি, কারণ সমুদ্র সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।