কাজল একবার থামিতেই পায়ের নিচের শুকনো বাঁশপাতার মচমচ শব্দও থামিয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় লুকানো পাখিটার কুবকুব ডাক স্পষ্ট হইয়া ওঠে। বাঁশপাত হইতে কেমন একটা গন্ধ ওঠে-কাজলের মন-কেমন-করা ভাবটা বাড়িয়া যায়। উপরে-নিচে কোনদিকেই পাখিটাকে দেখা যায় না। রানুপিস ডাকটা চিনাইয়া দিয়া বলিয়াছিল-কুবোপাখি। কাজলের হাসি পাইয়াছিল নামটা শুনিয়া। কেমন নাম দ্যাখো-বলে কিনা। কুবো পাখি–
খোকার মধু-ঝরা হাসি দেখিয়া রানির কী একটা পুরানো কথা মনে পড়ে। এক পলকের জন্য সে অন্যমনস্ক হইয়া যায়। পরমুহূর্তে হাসিয়া বলে-পাগল একটা, এত হাসবার হল কী নাম শুনে?
কাজলের একবার মনে হয় ডাক বাঁদিকের ঝোপ হইতে আসিতেছে। সেদিকেই বনটা বেশি। ঘন। কিছুদিন আগে এই জঙ্গল হইতে কী একটা জন্তু শিকার করিয়া লইয়া গিয়াছে। কাজেই একেবারেই যে গা ছমছম করে না। এমন নহে। কিন্তু পাখিটাকে দেখিবার কৌতূহলও কম নহে। রানুপিসি বলিয়াছে লাল লাল চোখ-সে দেখিবে কেমন লাল চোখ।
কিন্তু বিশেষ সুবিধা করা যায় না। কিছুটা বাঁদিকে হাঁটিলে মনে হয় ডানদিক হইতে আওয়াজ আসিতেছে। ডানদিকে একটু অগ্রসর হইলেই আওয়াজটা পিছনে ঘুরিয়া যায়। আবার খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরিয়া পরে কাজল হাল ছাড়িয়া দেয়।
ভারি তো পাখি-পরে দেখা যাইবে। আরও একটু সন্ধান করিলে কি দেখা হইত না? নিশ্চয় হইত। নেহাত কাজ আছে বলিয়া তাহাকে অন্যত্র যাইতে হইতেছে।
সন্ধ্যায় সতুকাকার দু-একজন বন্ধুবান্ধব এপাড়া-ওপাড়া হইতে আসিয়া জোটে। মোটা কালোমত একজন লোক-গলায্য কঠি, ঠুকিয়া ঠকিয়া খোলটাকে ঠিক সুরে বাঁধে। পবে সবাই মিলিয়া কীর্তন শুরু করে। একদিন কাজলের খুব মজা লাগিয়াছিল। গানের মাঝামাঝি-যেখানে ‘কোথা যাও প্ৰভু নগর ছাড়িয়া’ পদটা আছে সেখানে সবাই এমন হ্যাঁ করিয়া দীর্ঘ টান দিয়াছিল যে কাজল হাসি চাপিতে পারে নাই। এতগুলি বয়স্ক মানুষকে এক সারিতে হ্যাঁ করিয়া বসিয়া থাকিতে দেখিলে কাহার না হাসি পায়?
কীর্তন তাহার খুব ভালো লাগে নাই। গানের যে স্থানটিতে তাহার আমোদ হয়, সে স্থানটিতেই উহারা পরস্পরের গলা জড়াইয়া ধরিয়া অশ্রুবিসর্জন করিতে থাকে। ব্যাপার দেখিয়া প্রথম দিন। সে অবাক হইয়া গিয়াছিল। রানি তাহকে খাওয়াইয়া বিছানায় শোওযইযা আসার পরেও এক একদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত গান হয়। শুনিতে শুনিতে সে ঘুমাইয়া পড়ে। কখনও কখনও বিনা কারণে মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া যায়-দেখে জানালা দিয়া সুন্দর জ্যোৎস্না আসিয়া বিছানায় পড়িয়াছে। বাহিরের আতাগাছটা-ভূতোবোম্বাই আমগাছটা-উঠানটা অপূর্ব জ্যোৎস্নায ভাসিয়া যাইতেছে। ঘুম-ঘুম চোখে সেদিকে তাকাইয়া থাকিলে বেশ লাগে। মনে হয়, কেহ যেন ওই জঙ্গল হইতে উঠানের জ্যোৎস্নায় আসিয়া দাঁড়াইবে। তাহার গায়ে রূপকথার দেশের পরিচ্ছদ, মৃদু চন্দ্রালোকে সে। একবার কাজলের দিকে তাকাইয়া হাসিবে-পরে ইশাবায় ডাকিয়া আনিবে সঙ্গীদের। একদল পরীর দেশের লোকে উঠান ভরিয়া যাইবে। তাহদের ভাষা বোঝা যায় না-কিন্তু তাহা সংগীতময়। উঠানের ধুলায় চাঁদের আলোয় ছায়া সৃষ্টি করিয়া তাহারা লীলায়িত ভঙ্গিতে নৃত্য করবে। মাঝে মাঝে কাজল নিজে অবাক হইয়া যায় তাহার চিন্তার গতি দেখিয়া।
এই সময় বাবার কথা মনে পড়ে খুব। রানুপিসি পাশে ঘুমাইতেছে। পিসির নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাইতেছে। জানালার বাহিরে উঠানে সেই অপার্থিব চাদের আলোর দেশ। এ সময় বাবা থাকিলে বেশ হইত। মনের যে ভোবই হোক না কেন, বাবাকে বুঝাইয়া বলিবার দরকার পড়েনাবাবা নিজেই কেমন সব বুঝিয়া লয়। বাবা হয়তো বলিতে পারিত কেন সে এমন অদ্ভুত চিন্তা করে। শুধু এ সব কারণেই নহে-অন্য কারণও আছে। হ্যাঁ, সে লুকাইবে না-বাবাকে দেখিতে ইচ্ছা করে, বাবার জন্য তাহার মন কেমন করিতেছে।
পরের দিন দুপুরে ললিতমোহন বাড়জ্যের ছেলে। চনু আসিয়া তাহাকে একা-দোক্কা খেলিতে ডাকে। চড়কতলার মাঠে খেলা জমিয়া ওঠে। অবশ্য কাজল খেলায় খুব পটু নহে। তাহার তাকও প্রশংসার অযোগ্য। তিন নম্বর ঘর টিপ করিয়া ঘুটি খুঁড়িলে সেটা পাঁচ নম্বর ঘরে পড়িবেই। অবশ্য প্রত্যেকবারই কাজল এমন ভান করিয়া থাকে যেন সে ওটা পাঁচ নম্বর ঘরেই ফেলিবার চেষ্টা করিতেছিল। খেলা সমাপ্ত হইলে সন্ধ্যার আরছা আঁধারে বাড়ি ফিরিবার সময় কাজল চনুকে প্রশ্নটা করিয়া ফেলে-তুই জানালার পাশে শুয়ে ঘুমোস?
চনু বাক্যালাপের গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া সংক্ষেপে বলে—
–রাত্তিরে জাগিস নে কখনও? চান্দনি রাত্তিরে?
–কত!
–কিছু দেখিস? মানে, ভাবিস কিছু?
–ভাবিব। আবার কী? দাদা গায়ে পা তুলে দেয় বলেই না ঘুম ভাঙে। পা-টা নামিয়ে দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কেন রে?
—মনে হয় না কিছু? এই, কোন অদ্ভুত দেশের কথা, কী গল্পে পড়া কোন লোকের কথা? গল্প বলিতে চনু পড়িয়াছে কথামালার ‘ব্যাঘ্র ও পালিত কুকুর’। তাহা চাঁদনি রাত্রে স্বপ্ন দেখিবার জন্য খুব আদর্শ উপাদান নহে। কাজলটা কি পাগল নাকি? সন্ধ্যাবেলা যত উদ্ভট কথা! না, চন্দ্রালোকিত রাত্রে অগ্রজের তাড়নায় জাগিয়া তাহার বিশেষ কিছু মনে হয় না।
কাজলও যে বিশেষ কিছু দেখিতে পায়, তাহা নহে। কিন্তু একফালি চাঁদের আলো-একটি পাতা খসিয়া পড়া হইতে সে অনেক কিছু কল্পনা করিয়া লইতে পারে। নিজের বৈশিষ্ট্য বুঝিবার বয়স তাহার হয় নাই—তবুও তাহার সঙ্গীদের সহিত একটা চিন্তাগত পার্থক্য সে অনুভব করিতে পারে। যেমন দুৰ্গা পিসির কথা। বাবা ও রানুপিসির কাছে গল্প শুনিয়া সে দুর্গার চেহারা ও স্বভাব কিছুটা কল্পনা করিয়া লইয়াছে, নির্জনে বসিয়া ভাবিতে চেষ্টা করিয়াছে, পিসি সামনে দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছে। এই একটা ফল কুড়াইয়া লইল কোন গাছতলা হইতে, এই আধখানা ভাঙিয়া তাহাকে দিল খাইতে। অপু ও রানি দুর্গার শৈশবের গল্পই করিয়াছে—এখন থাকিলে পিসির যে অনেক বয়স হইত, তাহা কাজলের কখনও মনে হয় নাই। শুধু এইটুকু সে বোঝে, পিসি বাঁচিয়া থাকিলে তাঁহাকে খুব ভালোবাসিত।