লোভ কথাটা উচ্চারণ করিবার সময় সে এমন ভাব করিল যেন সামনে সাপ দেখিয়াছে।
কাজল বলিল–তোমাকে যদি এখন কেউ এক লাখ টাকা দেয়, তাও নেবে না?
–কী করব নিয়ে? তাতে আমার মনের শান্তি চলে যাবে, সব সময়ে ভালো খেতে ভালো পরতে ইচ্ছে হবে। রাত্তিরে জেগে বসে থাকতে হবে, পাছে চোরে টাকা নিয়ে যায়। এই করে করে যখন বুড়ো হব, তখন হঠাৎ একদিন দেখবো আমার এক লাখ টাকা কবে জমার খাতা থেকে খরচের খাতায় চলে গেছে, জমার খাতায় মস্ত বড় একটা শূন্য। না না, খোকনবাবা, তিনি আমাকে যেন কখনও টাকাপয়সা না দেন—সে আমি সহ্য করতে পারবো না, মরে যাবো।
কাজলের রামদাসের প্রতি শ্রদ্ধা হইল। সে বলিল—কিন্তু সারাজীবন এই ভাবে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াতে তোমার ভালো লাগবে? শেষ জীবনে একটা আশ্রয় তো দরকার
রামদাস মৃদু মৃদু খঞ্জনী বাজাইতে বাজাইতে বলিল—ছন্নছাড়া! আমাকে ছন্নছাড়া বলছে, তোমার সাহস তো কম নয় বাবাজী। আমাকে তিনি যেমন রেখেছেন, তেমনি আছি। তিনি যেমনভাবে যেখানে খেলা শেষ করতে বলবেন, সেখানে তেমনিভাবে খেলা শেষ করে দেবো। তার হাতে আছি—তার মধ্যে আবার খারাপ ভালো কী?
কাজলের পক্ষে যদিও রামদাসের দর্শনের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভবপর হইল না, তবুও তাহার কথা কাজলের ভালো লাগিতেছিল। সহজ বিশ্বাসের সুরটি তাহার হৃদয় অধিকার করিতে বেশি সময় নেয় নাই।
কাজল বলিল—এর মধ্যে অনেক ঘুরেছ তুমি, না? গল্প বলো না শুনি।
হ্যাঁ, এই চার বৎসরে রামদাস অনেক ঘুরিয়াছে, অনেক নূতন জায়গা দেখিয়াছে। একস্থানে সে বেশিদিন থাকিতে পারে না, প্রাণ পালাই পালাই করে। দুনিয়াটা যদি ঘুরিয়াই না দেখিবে, তবে ঈশ্বর তাহাকে চোখ দুইটা দিয়াছেন কী প্রয়োজনে?
একবার তাহার এক সাকরেদ জুটিয়াছিল। সে জোগাড় করে নাই, লোকটা জুটিয়া গিয়াছিল। ভক্তিভাবের কথা বলে, গদগদ কণ্ঠস্বর। দিন সাতেক ছিল সঙ্গে। এক শহরে কোন এক বড়লোকের বাড়ি গান করিয়াছিল রামদাস। তাহারা খুশি হইয়া রামাসকে একখানা নূতন কাপড় দিয়াছিল। রাত্রে সামান্য আহার করিয়া দুইজনে একটা হাটচালায় শুইয়াছিল। পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া দেখে সাকরেদটি উধাও—তন কাপড়খানাও নাই।
কাজল বলিল—তুমি কী করলে তখন?
—কী আবার করবো? ভারি দুঃখ হল মনে। কাপড়টা চেয়ে নিতে পারতো আমার কাছ থেকে, আমি দিয়ে দিতাম। অনর্থক চুরি করে সে পাপের ভাগী হল।
-তোমার রাগ হল না?
—না বাবাজী। তার নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি দরকার ছিল, নইলে সে নেবে কেন? তবে আমাকে বললেই পারতো। মানুষের অসাধুতা দেখলে বড়ো কষ্ট পাই মনে। কী লাভ অসাধুতায়! সেই তো একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে চিরদিনের জন্য, তবে আর কেন পেছনে কুকীর্তি রেখে যাওয়া?
রামদাস বিদায় লইবার আগে কাজল তাহাকে বলিল—তুমি মাঝে মাঝে আসবে তো রামদাস কাকা? আমাদের বাড়ি তো চেনা হয়ে গেল।
–বলতে পারি না বাবাজী। কখন কোথায় থাকি তার তো ঠিক নেই। আজ এখানে আছি, কাল থাকব আর এক জায়গায়। সেখো না, সেই মাধবপুরের মাঠের পর আবার কতদিন বাদে আমার দেখা হল।
—তুমি বোধ হয় কাউকেই বেশি ভালোবাসোনা রামদাস কাকা, তাহলে কি না দেখে থাকতে পারতে? খালি ঘুরে ঘুরে বেড়ালে আর একজনকে ভালোবাসা যায়?
প্রশ্নটা শুনিয়া রামদাস কেমন অন্যমনস্ক হইয়া গেল, আনমনে খঞ্জনীতে টিন-টিন আওয়াজ তুলিতে লাগিল। কাজল বলিল—সত্যি কথা বলিনি, কাকা?
মুখটা এদিকে ফিরাইয়া রামদাস বলিল—একজনকে ভালোবাসার জন্য তো জীবনটা নয় বাবাজী, আমি চেয়েছিলাম সবাইকে ভালোবাসতে। তা আর হল কই? একজনকে ভালোবাসলে জীবনটা বড়ো ছোট হয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে ভালোবাসার মতো হৃদয়ও তো ভগবান আমাকে দেননি, কী করি তুমিই বলো?
একটু চুপ করিয়া রামদাস বলিল—এখন মনে হয় গাছ নদী ফুল ফল সবকিছুর ভেতরেই আলাদা করে দেখবার মতো রূপ আছে, এমন কী পাথবের মধ্যে মাটির মধ্যে আলাদা সত্তা–আমি তাই দেখি। কী পেলে চাওয়া আমার পূর্ণ হয় তা আমি এখনও জানি না, তারই সন্ধানে ঘুরে বেড়াই।
অপুর শেষ উপন্যাসটা পাঠকমহলে আলোড়ন আনিয়াছিল। জীবনকে এত বিচিত্রভাবে অন্য কোনো লেখক দেখেন নাই—এই বলিয়া বড়ো বড়ো কাগজে সমালোচনা বাহির হইল। নূতন উপন্যাসখানির কাটতি অত্যন্ত বেশি, অন্যান্য বইও ভালো চলিতেছে। অপুর মৃত্যুর পর পাঠকেরা হঠাৎ যেন তাহাকে লইয়া ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে।
বইপত্র হইতে আয়ের হিসাব এবং টাকাকড়ি আদায় ইত্যাদি এখন সুরপতি ও প্রতাপ করিয়া থাকে। হৈমন্তীর ভাঙা সংসারের হাল সুরপতি এখন শক্ত হাতে ধবিয়াছেন। মেয়েকে অভয় দিয়া বলিয়াছেন—তোর কোন ভয় নেই, হৈম, কাজলের ভবিষ্যতের ভার আমার হাতে রইল।
গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্র পৃথিবীটাকে পোড়াইয়া খা করে, বর্ষায় ঝর ঝর করিযা বৃষ্টি পড়ে অদৃশ্য হস্তনিষিক্ত শান্তিবারির মতো। হেমন্তে শিশির পড়ে, শীতে কুয়াশা পাক খায়—সমস্ত হৈমন্তী জানালায় বসিয়া দেখে। যে দেখিতে শিখাইয়াছিল, সে নাই।
কলিকাতা হইতে প্রথম প্রথম যখন প্রকাশকদেব নিকট হইতে অপুর লেখার জন্য মনি অর্ডার আসিত এবং হৈমন্তীকে সই করিয়া টাকা লইতে হইত, তখন হৈমন্তীর চোখে জল আসিত। সে যেন খালি টাকা চাহিয়াছিল! এ সকলইয়া সে কী করিবে? শেষ বইটা এত নাম করিল, অপু দেখিয়া গেল না। স্বামীর এত সুনাম এত যশ লইয়া সে এখন কী করিবে?