কথা শেষ হইতে না হইতে ঝম ঝম বৃষ্টি নামিল। ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল—ঢোক মন্দিবে।
হুড়মুড় করিয়া তাহারা মন্দিরে ঢুকিল। বৃষ্টির তোড় প্রতি মুহূর্তে বাড়িতেছে। সাবধানে শিবলিঙ্গের স্পর্শ বাঁচাইয়া দুইজনে এক কোণে চুপ করিয়া দাঁড়াইল। দরজার ফ্রেমে আটকানো বাহিরের বনজঙ্গল, মন্দিরের চাতালেব কিয়দংশ প্রচণ্ড বৃষ্টিতে অদ্ভুত দেখাইতেছে। কাজল বলিলমুশকিল হল, এখন ফিরবো কী করে?
–ফেরবার তাড়া কীসের? বেশ তো লাগছে। ব্যোমকেশের গলা স্বপ্নালু।
বৃষ্টি কমিল না। জোলো হাওয়া এক একবার ভীষণ দাপটে দরজার ভাঙা পাল্লাটাকে খটখট করিয়া নাড়িতেছে। বাতাসের জোর খুব বাড়িয়াছে, অত ভারি পাল্লাটা নাড়িতেছে তখন। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট আসিয়া পড়িতেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত শীত করিতে লাগিল।
ঘরের ভিতর কিছু দেখা যায় না, ঘন অন্ধকার। ব্যোমকেশ বলিল–যখন আলো জ্বাললাম, ঠাকুরের মাথায় ফুল দেখেছিলি অমিতাভ?
–হুঁ।
–তার মানে, রোজ কেউ পুজো করে যায়। কুলুঙ্গিতে কী আছে দেখি দাঁড়া, মানুষ এখানে আসে যখন–
একটু পরেই অন্ধকারের ভিতর আবার ব্যোমকেশের গলার স্বর—কী পেলাম বল তো?
-কী?
–মোমবাতি। দাঁড়া জ্বালি। মোমবাতির সঙ্গে আরও একটা জিনিস আছে। গাঁজার কল্কে।
মন্দিরে অতএব শিবভক্তদের আনাগোনা প্রমাণিত হইল। কাজলের হাসি পাইতেছিল। মোমবাতি জ্বালাইয়া সেটাকে কোণের দিকে রাখিয়া ব্যোমকেশ গান ধরিল–দেশ রাগে।
বাহিরে হাওয়ার মাতামাতি—অন্ধকার, ভিতরে মোমবাতির কাঁপা কাঁপা স্বল্প আলো, তাহার সহিত ব্যোমকেশের গান। কাজল ভুলিয়া গেল বাড়ি ফিরিতে আজ অনেক দেরি হইবে, মা ভাবনা করিবে। ভুলিয়ে গেল যে স্থানে তাহারা বসিয়া আছে, তাহা আদৌ নিরাপদ নহে। রোমাঞ্চকর পরিবেশ তাহাকে সব ভুলাইয়া দিয়াছিল।
দরজার কাছে দাঁড়াইয়া কাজল বাহিরে তাকাইল। ভাঙা নাটমন্দিরের দিকটা একেবারে ভূতের দেশ বলিয়া মনে হইতেছে। বিদ্যুৎ চমকাইলে চারিদিক পলকের জন্য আলোকিত হইয়া উঠিয়াই আবার আবছা অন্ধকারে ডুবিয়া যাইতেছে। দরজার দুইদিকে হাত রাখিয়া সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল।
একনাগাড়ে প্রায় চার ঘণ্টা বৃষ্টি হইয়া তারপর থামিল। ব্যোমকেশ আর কাজল পাশাপাশি হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল। কাহারও মুখে কথা নাই। এই চার ঘণ্টার অভিজ্ঞতা তাহাদের প্রাণ পূর্ণ করিয়া দিয়াছে। মেঘ জমিয়া আছে, তবে বৃষ্টি নামিবার আপাতত আর আশঙ্কা নাই।
রাত্রে কাজল চোরের মতো বাড়িতে পা দিল, তখন তাহাকে খুঁজিবার জন্য লোক বাহির হইয়া গিয়াছে।
একদিন কানে আসিল খঞ্জনীর বাজনা—কে যেন খঞ্জনী বাজাইয়া গান গাহিতেছে। মানুষটাকে কাজলের চেনা লাগিল, তারপরই দৌড়াইয়া লোকটির কাছে গিয়া ডাকিল–রামদাস কাকা!
রামদাস প্রথমে কাজলকে চিনিতে পারে নাই। একটু পরেই প্রসন্ন হাসিতে তাহার মুখ ভরিয়া গেল। পুরাতন দিনের অভ্যাসমত খঞ্জনীটা একবার দ্রুত বাজাইয়া বলিল—খোকনবাবা না? তুমি এখানে কোথায়? তোমাকে মাধবপুরের মাঠে দেখেছিলাম–
কাজল তাহাকে সমস্ত ঘটনা বলিল, শুনিয়া রামদাস অনেকক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। একটু পরে গলা সাফ করিয়া বলিল–বাবার সঙ্গে দেখা হলো না, আমারই দোষ। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ি যাবো–গিয়ে উঠতে পারি নি।
কাজল দেখিল রামদাস একই রকম আছে, বিশেষ বদলায় নাই। কথায় কথায় হাসে, কথায় কথায় খঞ্জনী বাজায়। অপুর মৃত্যুর কথা শুনিয়া সে একটুখানি গম্ভীর হইয়াছিল বটে, কিন্তু পরমুহূর্তেই হাসিয়া বলিল—আমারই বা আর কদিন খোকনবাবা? তার নামেই জীবন, তার নামেই মৃত্যু। নিজের নামে কিছু রাখলেই যত বখেড়া এসে জোটে। বেশ তো আমি তাঁর নাম করে—
কাজল বলিল—তুমি আজ আমাদের বাড়ি যাবে চলো, কোনো কথা শুনবো না।
–কিন্তু আজকাল আমি একবেলা আহার করি, ওবেলা একবার হয়ে গেছে।
–মিষ্টি খাবে চল, তাতে দোষ নেই। মা তো একাদশীর দিন মিষ্টি খান।
—মিষ্টি খাওয়া যায় হয়তো, কিন্তু অত হাঙ্গামায় কী দরকার? খাওয়াটাই সব নয়, তার চেয়ে কোথাও বসে একটু কথা বলি তোমার সঙ্গে।
কাজল কিছুতেই শুনিল না, রামদাসকে ধরিয়া বাড়ি লইয়া গেল।
হৈমন্তী যত্ন করিয়া আসন পাতিয়া বসাইয়া তাহাকে খাওয়াইল। খাইতে পাইয়া রামদাস ছেলেমানুষের মতো খুশি হইল। খাইবে না খাইবে না করিয়া অনেকগুলি মণ্ডা খাইয়া ফেলিল। হৈমন্তী মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল—আর দেবো বাবা?
রামদাস ব্যস্ত হইয়া বলে—আর না, আর না। খোকনবাবা, এবার তুমি খাও।
—আমি খেয়েছি কাকা, চলো তোমার সঙ্গে বরং একটু ঘুরে আসি।
বাহির হইবার আগে হৈমন্তী রামদাসকে বেশ বড়রকমের একটা সিধা আনিয়া দিল। সিধার চালের উপর একটা টাকাও আনিয়াছে। রামদাস হাসিয়া বলিল—এই সব কার জানো?
—এ আপনাকে নিতে হবে বাবা, সামান্য দিয়েছি।
–শ্রদ্ধার দান মাত্রেই অসামান্য, সামান্য নয়। কিন্তু এ তো আমি নিতে পারবো না।
–কেন বাবা?
—প্রয়োজন মতো আমি ভিক্ষা করি, প্রয়োজনের অধিক কখনও নিই না। তাতে আর একজনের অমে ভাগ বসানো হয়। আজ ভিক্ষা করে কালকের মতো চাল পেয়ে গেছি—আজ আর নেবে না।
বহু অনুরোধেও রামদাস রাজি হইল না। রাস্তায় বাহির হইয়া কাজলকে বলিল—নিলে কেবল লোভ বাড়ে, লোভ বড়ো খারাপ জিনিস খোকনবাবা।