পরীক্ষা হইয়া যাইবার পর কাজল ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তুই পরীক্ষা দিলি না কেন?
ব্যোমকেশ হাসিল। পরীক্ষা দিবে বলিয়াই খাতা-কলম লইয়া সে বাহির হইয়াছিল, পথে মাঠের দৃশ্যটা এমন ভাল লাগিয়া গেল যে বসিয়া একটা গান না গাহিয়া সে পারে নাই। গানটা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হওয়ায় দেড়ঘণ্টা সময় পার হইয়া গিয়াছি।
ব্যোমকেশ কোনদিনই প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করিতে পারে নাই। বৎসর চারেক বাদে একদিন কাজলের সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল—তখন ব্যোমকেশের খুব দুঃসময় যাইতেছে। পড়াশুনা হয় নাই, চাকরি পায় নাই। বাবা মারা গিয়াছেন, দাদার সংসারে অনটন—সেখানে বসিয়া বসিয়া খাওয়া ভাল দেখায় না। শুষ্ক মুখে চাকরির সন্ধানে ঘুরিতেছে। আর গান গায় না, আগের সে প্রাণোচ্ছলতা নাই। কাজলের খুব খারাপ লাগিতেছিল, কিন্তু করিবার কিছু ছিল না।
প্রথম আলাপের মাসখানেক বাদে একদিন বিকালে ব্যোমকেশ কাজলের বাড়িতে আসিল। কাজল ঘরে বসিয়া পড়িতেছে (পাঠ্য নহে—-অপাঠ্য বই), হৈমন্তী আসিয়া বলিল–বুড়ো, তোকে কে ডাকছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে আসতে বললাম, এলো না।
কাজল বাহির হইতেই ব্যোমকেশ বলিল—খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। চট করে একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে পড়বি। দেরি করিস না, যা
—কিন্তু যাবোটা কোথায়?
—সে সব পরে। আগে বেরিয়ে আয়।
বাহির হইয়া ব্যোমকেশ বলিল—বিপুলগড়ের শিবমন্দিরে যাবো, চল্। যাবো যাবো করছিলাম, আজকে মনস্থির করে ফেলেছি।
—বিপুলগড়ে যাবি এখন? তোর কি মাথা খারাপ?
–মেলা বকিস না। খুব মজা হবে, দেখবি।
বিপুলগড় কাঁঠালিয়া ছাড়াইয়া অনেক দূর। গ্রামের বাহিরে জঙ্গলের ভিতরে একটা পোড়ো শিবমন্দির আছে। দিনের বেলাও কেহ সেখানে যায় না। কারণ প্রথমত ঘন জঙ্গল, দ্বিতীয়ত মন্দিরে আকর্ষণীয় কিছু নাই। বড়লোক জমিদার শখ করিয়া মন্দির বানাইয়াছিল–তাহারা সপবিবারে কলিকাতায় উঠিয়া গিযাছে। সে প্রায় সত্তর বৎসর আগের কথা। তাহাদের বড়ো বাড়ির ভগ্নাবশেষ পাশেই পড়িয়া আছে—জঙ্গলাবৃত অবস্থায়।
কাজল একটু আপত্তি করিয়া বলিল–বৃষ্টি আসতে পারে, দেখছিস না আকাশে মেঘ। অমন জায়গায় যাওযাটা উচিত হবে এখন?
–তবে থাক তুই।
ব্যোমকেশ সত্যই চলিয়া যাইতেছে দেখি কাজল দৌড়াইয়া তাহাকে ধরিল।
-রাগ করছিস কেন? চল, আমিও যাবো।
আকাশে মেঘ ছিল—আরও মেঘ চাপিয়া অন্ধকার হইয়া আসিল। ব্যোমকেশ বলিল–অ্যাডভেঞ্চারের পরিবেশ তো এই। মেঘলা দিন, জঙ্গলের ভেতরে পোড়ো মন্দির, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া। একেবারে পাঁচকড়ি দের গল্প, অ্যাঁ?
ততক্ষণে কাজলেরও ভাল লাগিতে শুরু করিয়াছে। ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিন পড়িয়া বহু দুর্গম দেশে সে মনে মনে অ্যাডভেঞ্চার করিয়াছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা সুঁড়িপথে তাহারা ঢুকিল। বেলা আছে, কিন্তু মনে হইতেছে সন্ধ্যা নামিল বলিয়া। শিবমন্দিবের চাতালে উঠিয়া দুইজনে দাঁড়াইল। মন্দিরের মাথায় বটগাছ গজাইয়াছে, ভারি কাঠের দরজা ভাঙিয়া কব্জায় আটকাইয়া ঝুলিতেছে। চাতাল চৌকা টালি বসাইয়া তৈয়ারি, এতদিন বাদেও বেশ মসৃণ। একটুও শব্দ নাই কোন দিকে, বাতাসে একটা বন্য গন্ধ।
কাজল চালের উপর বসিয়া পড়িল। কয়েকটা কালো ডেয়ো পিঁপড়া এখানে ওখানে ঘুরিতেছে। ঠিক নিচেই কতকগুলি বনতুলসীর গাছ জড়াজড়ি করিয়া আছে। দূরে ভাঙা নাটমন্দির দেখা যাইতেছে। কাজল ভাবিতেছিল, এই জায়গাটা না জানি কত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। দেলদুর্গোৎসবে কুলবধুরা ভিড় করিয়া পূজা দেখিত, ঝাড়লণ্ঠনের আলো প্রতিমার মুখে পড়িয়া ঘামতেল চকচক করিত। সন্ধ্যায় শাঁখ বাজিত, বৃদ্ধারা মালাজপ করিতেন। কে কোথায় চলিয়া গিয়াছে—কেহ নাই, কিছু নাই। তাহাদের চিহ্ন পৃথিবী হইতে একেবারে মুছিয়া গিয়াছে সাক্ষী হিসাবে রহিয়াছে কেবল এই ভাঙা নাটমন্দির।
ব্যোমকেশ ডাকিল–অমিতাভ।
–কী?
কী রকম একটা লাগছে না? কাজল ব্যোমকেশের দিকে তাকাইল। ব্যোমকেশের মুখ গম্ভীর, যেন একটা ভয়ানক কিছুর জন্য অপেক্ষা করিতেছে।
-কী রকম লাগছে মানে?
—চারিদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব, তাই না? এমনি জায়গাতেই তো বহুদিনের মৃত আত্মারা নেমে আসে।
কাজল সমর্থন করিল। আসিয়াই জিনিসটা সে অনুভব করিয়াছে। বাতাসে রহস্যের গন্ধ। সাধারণত জীবনে যাহা ঘটে না, তাহা যেন এখানে এখনই ঘটিবে। কিছুদিন আগেই সে রিপ ভ্যান উইঙ্কল পড়িয়াছে। ওই সুঁড়িপথটির বাঁক হইতে এখনি হাফমুন জাহাজের কোনো মৃত নাবিক বাহির হইয়া আসিলে সে বিন্দুমাত্র অবাক হইবে না।
ব্যোমকেশ বলিল—মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখি চল—
ভিতরে বেশ অন্ধকার। ব্যোমকেশ পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া জ্বালিল। কাঠি পুড়িতে যতটা সময় লাগে তার মধ্যেই দেখা গেল, মন্দিরের ভিতরে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ, তাহার মাথায় কয়েকটি ফুল। ঘরের ভিতরে আর কিছু নাই—দেওয়ালে একটা কুলুঙ্গি ছাড়া।
বাহিরে আসিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিল–একটু ভূপালী গাই।
কাজল হাঁটুর উপর থুতনি রাখিয়া শুনিতে লাগিল। ভূপালী রাগ ব্যোমকেশ ভালোই আয়ত্ত করিয়াছে। দরাজ গলায় ষড়জ লাগাইয়া আলাপ শুরু করিল। এমন সময় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়িল। গান থামাইয়া ব্যোমকেশ উপরদিকে তাকাইয়া বলি—বৃষ্টি এলো বলে মনে হচ্ছে।