কাজল এবং ফরসা ছেলেটি কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকাইয়া রহিল। নীরবতা অস্বস্তিকর হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া কাজল বলিল—গাও না, বেশ তো গাইছিলে।
ছেলেটি হাসিল। ময়লা বিছানার এক প্রান্ত হাত দিয়া ঝাড়িয়া বলিল—এখানে বসো।
এতক্ষণে কাজলের মনে পড়িয়াছে, ছেলেটি তাহাদেরই ক্লাসে অন্য সেকশনে পড়ে। আলাপ হয় নাই, দূর হইতে বারকয়েক দেখিয়াছে। কাজল জিজ্ঞাসা করিল-তুমি তো বি-সেকশনে পড়ো, না? তোমার নাম কী?
ছেলেটি মাথা পিছনে হেলাইয়া, চোখ অর্ধনিমীলিত করিয়া গম্ভীর গলায় বলিল—আমার নাম ব্যোমকেশ চৌধুরী।
তাহার ভঙ্গি দেখিয়া সন্দেহ হইতে পারিত সে বলিতেছে–আমার নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
কাজল বুঝিল একটি অদ্ভুত চরিত্রের সহিত তাহার পরিচয় হইতে চলিয়াছে। সে আন্টির বিছানায় বসিল।
—তুমি কী গাইছিলে? সুন্দর সুর।
–মালকোষ গাইছিলাম, বেশ মেজাজ আসে গাইলে।
কাজল অবাক হইল। এ অঞ্চলে রবীন্দ্রসংগীতই কেহ গায় না, তার উপর রাগসংগীত।
-তুমি গান শেখো?
—ছোড়দা শেখে। ছোড়দা ওস্তাদের কাছে শেখে, আমি ছোড়দার কাছে শিখি। কাজেই আমিও শিখি বলতে পারো। তুমি সিগারেট খাও?
খাওয়া দূরের কথা, কাজল কল্পনাও করিতে পারে না।
—আমিই খাই তবে।
পকেট হইতে একটা সিগারেট বাহির করিয়া আন্টির বিছানার নিচ হইতে ব্যোমকেশ দেশলাই বাহির করিল। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল—আমাদের দেশ বগুলায়। বগুলার নাম শুনেছো? বগুলার কাছেই কুমারী রামনগর গ্রামে আমাদের বাড়ি। বাবা ডাক্তার। তোমার বাড়ি কোথায়?
আমাদের দেশ নিশ্চিন্দিপুবে, সেও গ্রাম। বাবা মা যাওয়ার পর এখানে মামাবাড়িতে থাকি।
-রবি ঠাকুরের কবিতা কেমন লাগে?
কাজল বিপদে পড়িল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাহার খুব বেশি পড়া নাই, দুই-একটা যাহা পড়িয়াছে, সম্পূর্ণ মানে বোঝে নাই। বলিল—বেশি তো পড়ি নি, যা পড়েছি বেশ লেগেছে।
অনেক কথাবার্তা হইল। কাজল দেখিল, ব্যোমকেশ একটু ছিটগ্রস্ত। মনের খুশিতে ঘোরে, গান গায়, বই পড়ে। মাঠে মাঠে ঘুরিয়া গাছপালা চিনিয়া বেড়ায়। এমন সব গাছপালাব নাম করিল, যাহা কাজল চিনিলেও অনেক শহুরে ছেলে নামও শোনে নাই। উঠিবার সময়ে আড়মোড়া ভাঙিয়া বলিল—তাও কতকিছু ভুলে যেতে বসেছি। গ্রামে থাকতে অনেক কিছু জানতাম–
—গ্রাম ছেড়ে এলে কেন?
–ছোড়দা এখানে চাকরি করে। ছোড়দার কাছে থেকে পড়ি। বাবর একার আয়ে চলে না। নতুন পাস করা ভালো ভালো সব ডাক্তার গিয়ে বাবার পসার মাটি করেছে। বাবা খুব তেজী সোক ছিলেন, জানো? অনেকদিন আগে সেটেলমেন্টের লোক জমি জরিপ করতে গিয়েছিল—সঙ্গে ছিল এক সায়েব। সে কঠিন অসুখে পড়লে বাবা চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তোলেন। সায়েব বলেছিল বাবাকে বিলেতে নিয়ে যাবে। এক রাত্তিরে বাবা তো পালিয়ে যাওয়ার মতলব করলেন। বাবার বয়স তখন সাতাশ-আটাশ, রক্ত গরম। কথা ছিল মাইল দশেক দূরে এক জায়গায় দেখা করার, সেখান থেকে সায়েব বাবাকে নিয়ে চলে যাবে, ঠাকুমা কী করে জানতে পেরে আগে থেকে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বাবা ঘোড়ায় চেপে বাড়ির পাশে বড়ো আমবাগানটা পার হচ্ছেন, ঠাকুমা এসে পড়লেন একেবারে ঘোড়ার সামনে। বললেন–হরু, যেতে হয় আমার উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে যা। বাবার আর বিলেতে যাওয়া হল না।
পরের দিন আবার দেখা হইবে বলিয়া কাজল বিদায় লইল।
ব্যোমকেশের সহিত কাজলের ঘনিষ্ঠতা বেশ বাড়িয়া উঠিল। দুইজনে শহর ছাড়াইয়া গ্রামের দিকে বেড়াইতে যায়, কাঠালিয়া গ্রামের আখের আলির বাড়ি যায়। ব্যোমকেশ মাঠের মধ্যে হাত পা নাড়িয়া গান করিতে করিতে হাঁটে। কখনও বৃষ্টি আসিলে দুজনে দৌড়াইয়া চাষীদের ধান পাহারা দেওয়া চালার নিচে আশ্রয় নেয়। বৃষ্টি দেখিতে দেখিতে ব্যোমকেশ একটা সিগারেট ধরাইয়া বলে— চমৎকার বৃষ্টি, গাইতে ইচ্ছে করছে। দেশ আর মল্লার—এ দুটো ঝম ঝম বৃষ্টিতে ভারি জমে, বুঝলে?
কোথায় একটা পাখি ডাকিয়া ওঠে—কুউ-কুউ-কুউ-কুউ। স্বরটা খাদ হইতে আরম্ভ হইয়া চড়ায় গিয়া শেষ হয়। ব্যোমকেশ বলে–বর্ষাকোকিল ডাকছে, শুনছো?
কাজল ডাকটা আগেও শুনিয়াছে, কিন্তু পাখির নামটা যে বর্ষাকোকিল তাহা জানিত না। সে বলিল—বর্ষার কোকিল আছে নাকি আবার?
–নেই তো ওটা কী ডাকছে?
চারিদিকে বুক সমান ধানগাছ দেখাইযা ব্যোমকেশ বলে—রামনগরে এইরকম ধানক্ষেতে বর্ষার দিনে আমাকে একবার সাপে তাড়া করেছিল। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে, আলের ওপর দিয়ে হাঁটছি, এমন সময় ধানগাছের ভেতর থেকে বিরাট এক কেউটে এসে আলের ওপর উঠল। কী তার ফেঁসফোসানি, কী তার কুলোপানা চক্কর! নেহাত আমার কাছে বেদের দেওয়া সাপের ওষুধ ছিল, তাই বেঁচে গেলাম।
-কী করলে ওষুধ দিয়ে?
—ওষুধ একরকম শেকড়। সাপের ভয়ে তাই সবসময পকেটে নিয়ে ঘুরতাম—আমাদের ওদিকে ভীষণ সাপের উপদ্রব কিনা। ছোবল মারবে বলে সাপটা যেই ফণা তুলেছে, অমনি শেকড়টা সামনে বাড়িয়ে দিলাম। সাপ মাথা নিচু করে চলে গেল, না কামড়ে।
স্কুল-জীবনে ব্যোমকেশ কাজলের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল—একমাত্র বন্ধু। পরে অবশ্য যোগাযোগ ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিন দিন পরীক্ষা দিবার পর ব্যোমকেশ আর আসিল না। কে আসিয়া বলিল—স্কুলে আসিবার সময়ে সে দেখিয়াছে ব্যোমকেশ মাঠের ধারে বসিয়া গান গাহিতেছে, পাশে খাতা-কলম-দোয়াত।