আদিনাথবাবু কাজলকে খুব ভালোবাসেন। ক্লাসে ছেলেদের উপদেশ দেন তাহাকে অনুসাবণ করিতে। পড়িতে পড়িতে কাজলের নিজস্ব একটা ইংরাজি লেখার ভঙ্গি তৈয়ারি হইয়াছে, তাহা আদিনাথবাবুর ভালো লাগে।
কাজল আগাইয়া গেল।–কী সার?
—আজ তোকে নিয়ে কী গোলমাল হয়েছে রে স্কুলে?
কাজল খানিকটা বলিতে তিনি বলিলেন-যে যা বলে বলুক। কারও কথায় আমল দিবি নে। পড়াশুনার অভ্যোস কখনও ছাড়বি নে, জীবনে উন্নতি হবে, দেখিস।
হৈমন্তী বসিয়া কী-একটা বই পড়িতেছিল। কাজলকে ঢুকিতে দেখিয়া বলিল–আয়। আজ এত দেরি হল যে আসতে? হাতমুখ ধুয়ে আয়, খেতে দিই।
স্কুল হইতে ফিরিয়া কাজল ভাত খাদ্য। হৈমন্তী আসন পাতিতে পাতিতে বলিল– আজকে রাত্তিরে শুয়ে সেই গল্পটা বলবি কিন্তু—
রাত্রে মায়ের কাছে শুইয়া কাজল মাকে গল্প শুনাইয়া থাকে। অপুর একটা ইংরাজি বইতে সে একটা ভূতের গল্প পড়িয়াছিল, সেই গল্পটা সম্প্রতি হৈমন্তীকে বলিতেছে।
দাদুর কাছে পড়া সাঙ্গ হইলে হ্যারিকেন লইয়া সে শতবঞ্চিব উপর বসিযা গল্পের বই পড়ে। ভূতের গল্প হইলে পরিবেশটা অদ্ভুত জমিয়া উঠে। হ্যারিকেনের আলোর পরিধির বাইরে যেন অজানা রাজ্য—আলোকবৃত্তের সামান্য পরিসবের ভিতরেই তাহার থাকিতে ইচ্ছা করে। গল্প খুব জমিলে কাজল কল ঘুরাইয়া পলতে আর একটু বাড়াইয়া দেয়।
খাওয়ার পর কাজল বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছিল। হৈমন্তী বলিল—আবার বেবুবি নাকি? তোর দেখা পাওয়া যায় না সারাদিন। এখন আবার টই টই করে বেরুবার কী দরকার? থাক, বাড়িতে থাক–
বোধহয় খুব একটা ইচ্ছা ছিল না বলিয়াই কাজল এক কথায় রাজি হইয়া গেল। বলিল–তুমি খাটে শোও মা। আমি পাশে শুয়ে গল্প করি। ব
হৈমন্তী প্রায়ই ছেলেকে নিজের ছোটবেলার গল্প শোনায়। যে দিনগুলি কাজল দেখে নাই, কাজলের ধারণা সেগুলি বর্তমানের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। অতীতের প্রতি তাহার যে স্বপ্নময় কল্পনা রহিয়াছে, তাহাই হৈমন্তীর গল্পকে তাহার নিকট বাস্তব করিয়া তোলে। সেই দুর্গাপূজার আগে শিউলি ফুল তুলিতে যাওয়া, শিউলি ফুলের বোঁটা দিয়া কাপড় রঙিন করা, দল বাঁধিয়া হৈ হৈ করিয়া ঠাকুর দেখি, বাহির হওয়া কাজলের ধারণা সে দিনগুলি অনেক ভালো ছিল—অনেক, অনেক ভালো। মাকে বলে–মা, সেই গল্পটা বলো, সেই ঢাকায় যা হয়েছিল।
ঢাকায় থাকার সময়, হৈমন্তী তখন খুব ছোট, কাজলের দিদিমা একবার গভীর রাত্রে উঠিয়া ঘুমের মধ্যেই দোতলা হইতে একতলায় আসিয়া গিয়াছিলেন। গভীর রাত, কেহ কোথাও নাই, হঠাৎ দিদিমা বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, বাবা এসেছেন–আমি দরজা খুলে দিই গে যাই। সুরপতি উঠিয়া পেছন পেছন গেলেন। দরজা খুলিয়া দেখা গেল, কিছুই নাই। তখনও দিদিমার ঘুম ভালো করিয়া ভাঙে নাই।
গল্প শুরু হইল। এক গল্প হইতে অন্য গল্পে যাইতে যাইতে ক্রমশ সন্ধ্যা হইয়া আসিল। জানালার বাহিরে দিনের আলো শেষ হইয়া আসিতেছে, ঘরের ভিতর এখনই আরছা অন্ধকার। হৈমন্তী গল্প থামাইয়া বলিল–যাই, সন্ধেটা দেখিয়ে আসি। দিদি বোধহয় চা করে ফেলল। এতক্ষণে।
কাজল চুপ করিয়া ছিল। পুরাতন দিনের গল্প, সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। উঠিতে গিয়া হৈমন্তী কী একটা মনে পড়িয়া যাইবার ভঙ্গিতে বলিল–একটা ব্যাপার হয়েছে, জনিস?
-কী?
–আজ কদিন ধরে দেখছি, যার কথা খুব ভাবি সে এসে হাজির হয়। বিয়ের আগে বকুলের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল, যাকে বলে গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। তার বিয়ে হয়েছে কোন্নগরে। আজ দুপুরে বকুলের কথা খুব মনে পড়ছিল। ওমা, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, দুপুরেই বকুল এসে হাজির। বললে-বেড়াতে এসেছি, তোমাদের এখান থেকে ঘুরে গেলাম। দুদিন আগে এলো উমা, তার কথাও ভাবছিলাম সেদিন।
কাজল হৈমন্তীর দিকে তাকাইল।
–যাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, সে-ই এসে হাজির হচ্ছে?
হৈমন্তী মাথা নাড়িল।
কাজল দরজার উপরে বাবাব ছবিটার দিকে তাকাইল। যদিও ঘর অন্ধকার, তবুও বাবার মৃদু হাসি ঠিক ধরা যায়।
১১. কাজলের স্কুল হইতে ফিরিবার পথে
একাদশ পরিচ্ছেদ
কাজলের স্কুল হইতে ফিরিবার পথে একটা দোকান পড়ে। ছাত্রেরা দোকান হইতে চকোলেট বিস্কুট কিনিয়া খায়। সেদিন কাজল দোকানটায় ঢুকিল। উদ্দেশ্য, বিশেষ এক ধরনের লজেন্স ক্রয় করা। একদিন খাইয়া ভালো লাগিয়াছিল, আবার কিনিবার জন্য সুরপতির নিকট হইতে পয়সা লইয়া আসিয়াছে।
দোকানদারকে সবাই আন্টি বলিয়া ডাকে। ওষ্ঠদেশে প্রলম্বিত গুম্ফযুক্ত একজন দশাসই পুরুষের উদ্দেশে কেন যে উক্ত বিদেশী স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি প্রযুক্ত হয় বোঝা মুশকিল। তবে মানুষটি ওই ডাকে সাড়া দিয়া থাকে কোনো উত্মা প্রকাশ না করিয়াই।
আন্টি কাজলকে লজেন্স গণিযা দিতেছে, এমন সময় দোকানের পিছন হইতে বেশ ভাল গলায় গাওয়া গান ভাসিয়া আসিল। কাজল জিজ্ঞাসা করিল—কে গান গাইছে আন্টি?
আন্টি বলিল—আপনাদের ইস্কুলেই ছেলে, এখানে এসে বসে মাঝে মাঝে।
আন্টি তর্জনী আর মধ্যমা একত্রে ঠোঁটের কাছে ধরিয়া হুশ হুশ করিয়া ব্যাপারটা বুঝাইয়া দিল।
কৌতূহলী কাজল দোকানের পিছন দিকে ঢুকিল।
জায়গাটা আন্টির শুইবার স্থান। দরমার বেড়া দিয়া ঘেরা, উপরে টিনের চাল। মেঝেয় কালি পড়া মেটে হাঁড়ি, এনামেলের সানকি, তোলা-উনান এবং ঘরের কোণে রাখা একটা প্যাকিং বাক্সে তৈল-তণ্ডুলাদি। একপ্রান্তের দড়ির খাটিয়ায় ময়লা কুটকুটে বিছানা, তাহার উপর বসিয়া একটি ফরসামত ছেলে চোখ বুজিয়া হাত সামনে বাড়াইয়া রীতিমত ওস্তাদি ঢঙে গান গাহিতেছে। কোনো ষষ্ঠেন্দ্রিয় দ্বারা কাজলের উপস্থিতি বুঝিয়া সে গান থামাইল এবং চোখ খুলিয়া তাকাইল।