মাঠের উপরে সেই সন্ধ্যায় তাহার এক অপূর্ব অনুভূতি হইল। বুঝিল, তাহার জীবন অন্যদের বাঁচিবাব প্ৰণালী হইতে একেবারে ভিন্ন রকম। অযথা সে পৃথিবীতে আসে নাই, তাহার একটা কিছু করিবার আছে। দিগন্তের ওই বিদ্যুচ্চমকের মতো সে জীবনের একঘেয়ে আকাশে চমক লাগাইয়া দিয়া যাইবে। উত্তেজনার প্রাবল্যে জোরে জোরে হাঁটিয়া কাজল বাড়ি পৌঁছিয়া গেল।
ঘরে ঢুকিতেই সুরপতি ডাকিয়া বলিলেন-কোথায় ছিলি দাদু?
–বেড়াতে গিয়েছিলাম দাদু, ওই গ্রামের দিকে।
–রাত বিরেতে মাঠে-ঘাটে বেশি থাকিস নে, সাপ-খোপ বেবোয়।
কাজল হাসিয়া জামাকাপড় ছাড়িয়া মুখ ধুইতে গেল। সুরপতি ডাকিয়া বলিলেন—চট করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। আজ একটু আলো নিভিয়ে বোস তো। বড়ো চঞ্চল হয়েছিস, তোর মনঃসংযোগ হবে না ইয়ে হবে–
মেঘ আকাশের অনেকখানি ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। বাতাস একদম বাহিতেছে না। ঝড় আসিতে পারে।
আঃ! মনে কোনো ভার নাই, মালিন্য নাই। দুপুরের দেখা সেই মাঠের মতো দিগন্তবিস্তৃত সবুজ জীবন।
ঘরে ফিরিয়া হৈমন্তীকে জড়াইয়া ধরিয়া কাজল বলিল–বড় ভালো লাগছে মা, আজ বড়ো ভালো লাগছে।
১০. হৈমন্তীর ঘরের দেওয়ালে
দশম পরিচ্ছেদ
হৈমন্তীর ঘরের দেওয়ালে দরজার মাথায় অপুর একখানা ছবি টাঙানো হইয়াছে। সারাজীবনে অপু ছবি তুলিয়াছে খুব কম। বিবাহের পরে পরেই হঠাৎ কী খেয়ালে কলিকাতার এক স্টুডিয়ো হইতে ছবিটা তুলিয়াছিল। রোজ স্কুলে যাইবার সময় কাজল বাবার ছবিকে প্ৰণাম করিয়া বাহির হয়। ছবিটা উঠিয়াছিল সুন্দর, মনে হয়। অপু হাসিহাসি মুখে ফ্রেমের ভিতর হইতে তাকাইয়া আছে। পারতপক্ষে হৈমন্তী ছবির দিকে তাকায় না, তাকাইলে বুকটা কেমন করিয়া ওঠে।
স্কুলে মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক পরীক্ষা লওয়া হয়। এক পরীক্ষায় কাজল বাংলা রচনা লিখিতে গিয়া বিদেশী উপন্যাস হইতে একটা উপমা দিয়াছিল, পরদিন তাহা লইয়া খুব হৈ-চৈ। বাংলার শিক্ষক অখিলবাবু ক্লাসে তাহার খাতাখানা লইয়া আসিলেন। প্রথমেই কাজলের খোঁজ করিলেন।
–অমিতাভ এসেছে? কোথায় সে?
কাজল ভীতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল।
–এসেটা তোমার নিজের লেখা?
–হ্যাঁ সার।
অখিলবাবু চোখ লাল করিলেন–আবোলতাবোল এসব কী লিখেছ?
আবোলতাবোল কোনখানটা কাজল ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।
–কী সার?
–যে বইটার কথা তুমি লিখেছে, সেটা পড়া আছে তোমার? না জেনে লেখো কেন? নাকি অন্য কারুর লেখা মুখস্থ করে লিখেছে? সত্যি কথা বলো।
কাজল লেখার মধ্যে ড়ুমার ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’-এর উল্লেখ করিয়াছিল। ইংরাজিতে বইটির শিশুপাঠ্য সংস্করণ সে পড়িয়াছে।
–বইটা আমি পড়েছি। সার।
–আবার তর্ক? মিছে কথা বলছে কেন? এই বই পড়েছে তুমি?
–মিছে কথা নয়। সাব, গল্পটা আপনাকে আগাগোড়া বলতে পারি।
কাজলের বয়সী কোনো ছেলে ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’ পড়িয়া থাকিতে পারে, এ কথা অখিলবাবু বিশ্বাস করিলেন না। তাহার দৃঢ় ধারণা হইল কাজল মিথ্যা কথা বলিয়াছে, এবং একবার বলিয়া ফেলিয়া এখন আর কথা ঘুরাইতে পারিতেছে না।
অল্প বয়সে যাহা হয়–সে যে অনেক পড়িয়াছে, ইহা লোককে না জানাইয়া কাজল শান্তি পাইতেছিল না। বাহাদুরি দেখাইবার জন্য সে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও বইটাব কথা উল্লেখ করিয়াছিল। অখিলবাবু চটিয়া হেডমাস্টার মশায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করিলেন। ললিতবাবু হেডমাস্টার, তিনি কাজলকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। অন্য ছেলেরা ভয় দেখাইল—যাও না, মজা দেখবে। ফিরে এসে পিঠে মলম লাগাতে হবে।
ললিতবাবু বলিলেন—অখিলবাবু বললেন, তুমি তাঁর সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করেছ। সত্যি?
–না।সার। উনি বললেন আমি মিথ্যে কথা বলছি, আমি নাকি বইটা পড়িনি। আমি বললাম যে গল্পটা ওঁকে শোনাতে পারি।
–সত্যি পড়েছে তুমি?
–সত্যি সার।
-ইংরাজিতে?
-হ্যাঁ সার। বাবা আমাকে বইটা উপহার দিয়েছিলেন। আমি এমন অনেক বই পড়েছি সার। কেন আমি শুধু শুধু অখিলবাবুর কাছে মিথ্যে কথা বলবো?
—আর কী কী বই পড়েছে তুমি?
–‘ডেভিড কপারফিল্ড’ পড়েছি, ‘গালিভারস ট্রাভেলস’, ‘ববিনসন ক্রুসো’, ‘টলস্টয়ের গল্প’一
—‘রবিনসন ক্রুসো’ কার লেখা?
–ডানিয়েল ডিফো-র।
ললিতবাবু টেবিলের ওপরে রাখা পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলেন–তোমাকে ইংরাজি কে পড়ান বাড়িতে।
-আমার বাবা পড়াতেন সার। বাবা মারা যাওয়ার পর দাদু পড়ান।
—বেশ। পড়াশুনা করা ভালো, তবে মাস্টারমশাইদের মুখের ওপর তর্ক কোরো না। বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্। পড়ে যাও, পড়া ভালো।
কাজল চলিয়া গেলে হেডমাস্টার অখিলবাবুকে ডাকাইলেন।
–ছেলেটি মিথ্যে কথা বলেছে বলে তো মনে হলো না অখিলবাবু।
–বাচ্চা ছেলে ওইসব বই পড়েছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন? তাছাড়া এই বয়সে ওইসব পাকামির বই পড়া কি ভালো?
–জিনিসটা ওভাবে দেখবেন না অখিলবাবু। বই তো খারাপ নয়। বিষয়বস্তুর কথা যদি বলেন, তবে বলতে হয়–
অখিলবাবু আলোচনা চাপা দিয়া দিলেন। বইটি তাঁহারও পড়া নাই।
বিকাল চারটায় স্কুলের ছুটি হয়। মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়া কাজল রোজ বাড়ি ফেলে। আজ ছুটির পরে বেশ ক্ষুধা অনুভব হওয়ায় অন্যদিন হইতে বেশি জোরে হাঁটিয়া সে বাড়ি ফিরিতেছিল। পথে স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক আদিনাথবাবু ডাকিয়া বলিলেন–অমিতাভ, শোন।