কাজল অনুভব করিল। তাহার মনে কোনো দুঃখ নাই, গতকাল রেললাইনের ধারে যে ভয়টা হৃৎপিণ্ড চাপিয়া ধরিয়াছিল, তাহাও অদৃশ্য। চারিদিকে শুধু ছায়াছায়া আলো, পাখির ডাক, ঘন বাঁশবনে নিঃকুম দুপুরে বাঁশ দুলিবার শব্দ। আর সবকিছুর সঙ্গে মিলাইয়া রহিয়াছে–ডেভিডের জীবনচিত্র।
বইটি রাখিয়া কাজল চিত হইয়া শুইল। গতকাল বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, মাটি সামান্য ভিজা। উপরে বাঁশপাতা জড়াজড়ি করিয়া একটা সবুজ চাঁদোয়া বানাইয়াছে, তাহার ফাঁক দিয়া আকাশ দেখা যায়। মাটি হইতে সোদা গন্ধ আসিতেছে। আবার বোধহয় বৃষ্টি হইবে-এক সার পিঁপড়া মুখে ডিম লইয়া ছুটিতেছে। বৃষ্টি হইবার আগে পিঁপড়া নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধ্যানে ঘোরে। একটা বাছুর গলায় দড়ি এবং দড়ির প্রান্তে আটকানো খোঁটাসুদ্ধ তাহার সামনে আসিয়া পড়িল। ছোট্ট বাছুরটা, কাহাদের কে জানে–খোঁটা উপড়াইয়া এখানে হাজির হইয়াছে। বাছুরের চোখের শান্ত দৃষ্টি তাহাকে মুগ্ধ করিল। সে হাত বাড়াইয়া ডাকিল–আয়, আয়।
নাক উঁচু করিয়া বাতাসে কী শুঁকিয়া বাছুরটা উলটা পথ ধরিল।
কেমন আরামে তাহার সময় কাটিতেছে। কাজলের একবার দেবেশের কথা মনে পড়িল। সে এখনও মৌপাহাড়িতে তেমনই বন্ধুদের সহ্যিক অকারণে হৈ হৈ কারিয়া কাঁটাইতেছে। একটা বই পড়া নাই, দুদণ্ড একলা বসিয়া চিন্তা করা নাই। এই ছায়ায় বসিয়া বই হাতে সে চিন্তা করিয়া যে আনন্দ পাইতেছে, সে আনন্দের সন্ধান কি সারা জীবনেও উহারা পাইবে?
বিকাল হইয়া আসায় সে বাঁশবাগান ছাড়িয়া গ্রামের ভিতরে চলিল। এক জায়গায় একটা পানাপুকুর টোপাপনায় আচ্ছন্ন হইয়া আছে। পানা সরাইয়া এক কিশোরী থালা মাজিতেছিল। কাজলকে দেখিয়া ত্বরিতপদে তালগাছের গুড়ির তৈয়ারি ঘাট বাহিয়া উপরে উঠিয়া দৌড়াইল। একটা কুকুর, বেশ স্বাস্থ্যবান, তাহার দিকে পুকুরের ওপার হইতে তাকাইয়া আছে। কাজলের মনে হইলআমার কালু বেঁচে থাকলে ঠিক অত বড়ো হত।
কালুর কথা মনে পড়িতে তাহার মন খারাপ হইয়া গেল। কালু মারা যাইবার পরেও তাহার গলার চেনটা উঠানের কাঠচাপার ডালে ঝুলিত।
সামনে একটা খোড়োচালের বাড়ি। কাজল উঠানে দাঁড়াইয়া ডাকিল–শুনছেন?
খাটো ধুতি পরা একজন বাহির হইয়া আসিল।
–কে? কী চাই?
–একটু খাবার জল দেবেন?
লোকটা কাজলকে আপাদমস্তক দেখিয়া বলিল–আমরা কিন্তু মুসলমান।
কাজল বলিল–হোক গে, আপনি দিন জল।
–ওখানে কেন? এই দাওয়ায় এসে বোসো খোকা।
–এই গ্রামে বুঝি সবাই মুসলমান?
লোকটা হাসিয়া বলিল–না, না। সবাই নয়, আমরা কয়েকঘর আছি আর কী?
তাহার পর যেন একটা খুব গোপনীয় কথা হইতেছে, এমনভাবে মুখটা কাজলের কাছে আনিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল–মুড়ি খাবে দুটো?
ভাব জমিয়া গেল।
একটু পরেই কাজল দাওয়ায় বসিয়া মুড়ি খাইতে খাইতে গল্প করিতেছে, নাক দিয়া সর্দি ঝরা একটা বাচ্চা পাশে রাখা ডেভিড কপারফিল্ডখানা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে।
লোকটা বলিল–আর দেবো মুড়ি?
–না, এই অনেক। তোমার নাম কী?
লোকটা নাম বলিবাব আগে গামছায় একবার মুখ মুছিয়া লইল, যেন তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে।
–আমার নাম আখের আলি।
ভিতর হইতে একটি বৌ আসিয়া তাহার সামনে একটা বাটি নামাইয়া রাখিল। কাজল অবাক হইয়া বলিল–এ কী! দুধ কে খাবে?
বৌটি বলিল–খেয়ে নাও। আমাদের নিজেদের গরুব দুধ, ছিটেফোঁটাও পানি নেই। চিনি দেওয়া আছে, মুড়ি দিয়ে খাও। শুধু মুখে মুড়ি খেতে নেই।
কাজল আখেরকে জিজ্ঞাসা করিল–এ কে?
-আমার বৌ। ওর নাম রাবেয়া।
-এত দুধ খেতে হবে?
আখের আলি বলিল–উপায় নেই, রাবেয়া বিবি যখন ধরেছে, তখন আর–আমাকেই কেবল মোটে আদর যত্ন করে না।
রাবেয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল–আঃ!
কাজল ভাবিল, বড়ো হইয়া সে তাহার দেখা মানুষ লইয়া–ইহাদের জীবন লইয়া উপন্যাস লিখিবে ডিকেন্সের মতো। এমন সময় গলায়-খোঁটা সেই বাছুরটা গুটিগুটি আখেরের উঠানে আসিয়া ঢুকিল। আখের বলিল–ওই এতক্ষণে এসেছে। সারাদিন ঘুরে ফিরে এখন আসা হলো। আমি গিয়ে দেখি, বুঝলে, খোটা উপড়ে কোথায় হাওয়া হয়েছে। তারপর আসছে আসছে করে এই এলো
কাজল এক চুমুকে কিছুটা দুধ খাইয়া বলিল–তোমাদের বাছুর?
খাওয়া হইলে আখের কাজলকে লইয়া তাহার পোষা হাঁস মুরগি ইত্যাদি দেখাইল। বলিল–কিছুদিন বাদে এসো, তোমাকে একটা হাঁসের বাচ্চা দেবো।
বইখানি বগলদাবা করিয়া কাজল আবার সেই বাঁশবন পার হইয়া মাঠে পড়িল। সূর্য ড়ুবিয়া গিয়াছে। বাঁশবাগানে ঘন ছায়া। সে যেখানটায় শুইয়াছিল, সেখানে বাঁশের খোলাগুলি এখনও পড়িয়া আছে। ছোটবেলায় নিশ্চিন্দিপুরে এই সময়টায় অন্ধকার বনের মধ্য দিয়া যাইতে ভয় করিত, ভাবিলে এখন হাসি পায়। গা ছমছমে অনুভূতি একটা হয় ঠিকই, তবে তাহা ভূতের ভয় নহে।
বাঁশবনটার মাঝখানে সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া গেল। ঘনায়মান অন্ধকারে সে একা। জনপ্ৰাণী নাই কোথাও কোনোদিকে। সন্ধ্যার শব্দহীনতায় বাঁশ দুলিবার শব্দটা আরও স্পষ্ট লাগে।
মাঠের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে কাজল দেখিল, দিগন্তে মেঘ জমিয়া বিদ্যুৎ চমকাইতেছে। মনে অদ্ভুত আনন্দ। আখেরের সহিত সন্ধ্যাটা খুব ভালো কাটিয়াছে। অচেনা অজানা মানুষ কত তাড়াতাড়ি আপন হইয়া যায়। আবার সে এখানে আসিবে।