একটু বাদে ওঁর ডাক আবার কানে গেল-শুনে যাও।
আমি রান্নাঘর থেকে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে।
এমন করে তো উনি ডাকেন না। আমাকে! আমি যেতেই উনি বললেন-দেখ, আমার বুকে যেন চিড়ে আটকে গেছে।
আমি বললাম, শূকনো চিড়ে খেলে এমনিই হয়। ভিজিয়ে খেতে চাও না। আম কলা না থাকলে। কত ঘুরে এসেছ, গলা শুকিয়ে আছে না?
আমি ওঁর গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
উনি বললেন, একটু কোরামিন দাও আমাকে।
আমার ঘরে কোরামিন থাকত। আমার দেওর নুট্রবিহারী ডাক্তার ছিলেন। আমি ওঁকে ধরে আছি-আমার জা, যমুনাকে ডেকে বললাম-দশ ফোঁটা কোরামিন দে তো।
আমি জীবনে ওঁকে খুব সামান্যই ওষুধ খেতে দেখেছি। কোরামিন চাওয়ায় আমি ঘাবড়ে গেলাম খুব। সেই সূচনা। তখন বুঝিনি। আমি। স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। একটু পরেই সামলে উঠলেন কিছুটা। আমিও তখন অনভিজ্ঞা। বুঝতে পারিনি কী কঠোর নিয়তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
উনি স্নান করতে যাবেন বললেন। বাড়িতে স্নান করতেন না কখনও। দেশে থাকলে নদীতে, ঘাটশিলায় নানা পুকুরে। আমাকেও মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। ইদানীং বাবলুকে নিয়ে যেতেন রোজ-আমি না গেলেও।
সেদিন বললেন-আজ আর বাবলুকে নেব না, শরীরটা ভালো নেই।
অনেক বাধা দিলাম। শরীর ভালো নেই, বাইরে স্নান কবতে যেও না তুমি।
কিছুতেই শুনলেন না।
আমি বললাম-উঠোনের ধারে জল দিই তোমায়। বাথরুমে নাই বা নাইলে। বাথরুমে স্নান করতে একদম ভালবাসতেন না। উনি। আমাদের ঘরের সামনের চওড়া সিঁড়িগুলিতে বসে স্নান করতে বলেছিলাম। আমি।
উনি বললেন–কিছু হবে না। যাব। আর আসব।
তখন কিছু হল না।
দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন, তখন ধলভূমগড় বাজবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ কবে গেল টি-পার্টির। উনি খুশী হয়ে বললেন-যাব ঠিক, বঙ্কিমবাবুকে গিয়ে বল। দু-একজন কাকে আরও নিমন্ত্রণ করতে বললেন। তখনও জানি না, কী আছে আমাদের কপালে।
একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ঠাকুরপোর ডাকে ঘুম ভাঙল–দাদা কী সাজে যাচ্ছে উঠে দেখ বৌদি।
আমার দুরন্ত অভিমান হল। আমার কী একটুও ইচ্ছে করে না। উনি একটু সাজুন?
আমি চুপ করে রইলাম। উনি হয়তো বুঝলেন আমার অস্তরের অভিমান। তাই বললেনদাও কী দেবে। কী হবে সাজলে-গুজলে? দুখানা হাত বেবুবে আমার?
সেইদিন-আর তারপর তিনদিনের দিন ওকে মহাযাত্রায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম।
আপনাদের আশীর্বাদে বাবলু ‘কাজল’ লিখেছে। আজ সকলের সঙ্গে ওঁর আশীর্বাদও বাবলুর মাথায় ঝরে পড়ুক।
বাণভট্টের পুত্ৰ ভূষণভট্ট অসমাপ্ত ‘কাদম্বরী’ শেষ করেছিলেন। বাবলুর হাতে বিভূতিভূষণ পরিকল্পিত ‘কাজল’ প্ৰাণময় হয়ে উঠক এই আমার মঙ্গলময়ের প্রতি প্রার্থনা।
রমা বন্দ্যোপাধ্যায়
(বিভূতিভূষণ ‘কাজল’ উপন্যাস শুরু করার পূর্বেই লোকান্তরিত হন। এই গ্রন্থের সমগ্ৰ আখ্যানভাগই বিভূতিভূষণ-তনয় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত।)
১. শীত শেষ হইয়া বসন্তের বাতাস
প্ৰথম পরিচ্ছেদ
শীত শেষ হইয়া বসন্তের বাতাস বহিতে শুরু করিয়াছে। পুরাতন পাতা ঝরিয়া গিয়া গাছে গাছে নতুন কচি পাতার সমারোহ। এই দিনগুলাতে কাজলের বেশিক্ষণ বাড়িতে মন বসে না-বিশেষত বৈকালের দিকে। সূর্য বাশবনের মাথা ছাড়াইয়া একটু নামিলেই রোদটা কেমন রাঙা আর আরামদায়ক হইয়া আসে। রানুপসিদের গাইটা অলস মধ্যাহ্নে জঙ্গলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘাস লতা খায়। কাজল উত্তরের জানালায় বসিয়া লক্ষ করে। কিছুক্ষণ পরে তাহার আর মন টেকে না-বাহিরে যাইবার জন্য ছটফট করিতে থাকে। বন্য লতাপাতার যে বিশেষ ঘ্রাণটা বাতাসে বহিয়া আসেসেটাই যেন তাহাকে আরও চঞ্চল করিয়া তোলে। গন্ধটার সহিত এই বাহিরে যাইবার ইচ্ছার যে কী সম্পর্ক-তোহা সে বুঝিতে পারে না, কেমন যেন রহস্যময় ভাব হয় মনে।
সন্তৰ্পণে দরজার খিল খুলিতে গেলে অসাবধানে আওয়াজ হয়। রানু আসিয়া বলে-ছেলের বুঝি আবার বেবুনো হচ্ছে?
কাজল একটু অপ্রতিভ হয় বটে, কিন্তু ভয় পায় না। খিলটা হাতে ধরিয়াই দুষ্টামিব হাসি হাসিতে থাকে।
বাহির হইতে দিতে রানুর আপত্তি নাই। শুধু সাবধান করিয়া দেয়—খবরদার, নদীতে নামবি নে, নৌকোয় উঠবি নে কিন্তু-বল, উঠিবি নে?
কাজল প্রতিজ্ঞা করিয়া। তবে বাহিরে যাইবার অনুমতি পায়।
অপু বলিয়া গিয়াছিল—দেখো রানুদি, নদীতে যেন একলা না যায়। চান করবার সময় তুমি সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেমানুষ, সাঁতার জানে না-ড়ুবে যেতে পারে। কাজলও রানুপিসির কথার অবাধ্য হয় না-ইছামতীর ঘাটে জেলেদের মাছধরা নৌকাগুলি বাধা থাকে। এপাড়ার ওপাড়ার কিছু ছেলে জমা হইয়া তাহার উপর উঠিয়া খেলা করে। কাজলের পাড়ে বসিয়া দেখা ছাড়া গত্যন্তর নাই। পিসি বারণ করিয়াছে যে।
বাড়ি হইতে বাহির হইয়া কাজল বাবার নতুন কেনা আমবাগানের দিকে হাঁটিতে থাকে। বাগানের প্রান্তে কাহাদের একটা বাঁশঝাড়। সতুকাকা সেদিন বলিতেছিল বাঁশগাছ নাকি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। রাতারাতি নাকি বাঁশের কোঁড় একহাত লম্বা হইতে দেখা গিয়াছে। কথাটা শুনিয়া কাজলের মনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জাগিয়া উঠিল। তাই এ জায়গাকেই সে উপযুক্ত স্থান হিসাবে নির্বাচিত করিয়াছে। বাগানের শেষ গাছটার নিচে একখানি বাঁশেব কোঁড় হইয়াছে। হাত দিয়া মাপিয়া আমগাছের গুড়িতে সমান উচ্চতায় কাজল ঝামা ঘষিয়া একটা দাগ দিয়া রাখে প্রত্যেক দিন। পরের দিন গিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে গাছ কতখানি বাড়িল। গাছটার কাছে পৌঁছিয়া কাজল ভালো একটা ঝামা খুঁজিতে লাগিল। কাছাকাছি পাওয়া গেল না। কাজলকে ঢুকিতে হইল বাঁশবনের মধ্যে। বাঁশবনের ভিতরকার আগাছা কেহ কোনদিন পরিষ্কার করে না–মালিকের দায় পড়ে নাই। নির্দিষ্ট সময়ের শেষে কয়েক গাড়ি বাঁশ কাটিয়া চালান দিয়া সিন্দুকে পয়সা তুলিলেই তাহার কাজ শেষ। বাঁশ তো বিনা যত্বেই বাড়ে। তাহার জন্য আবার কে–