সেই শুরু, তারপর তিনবছর পার হয়ে চারবছর চলছে। আজ কাজল সত্যিই শেষ হল।
আমার শ্বশুরমশাই-এবা অসমাপ্ত কাৰ্যভার তুলে নিয়েছিলেন তার পুত্র অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে। আজ তাদের পায়েব তলায়, বঙ্গবাণীর পায়ের তলায় বাবলু কুষ্ঠিত অক্ষম পদক্ষেপে পূজার থালা নিয়ে দাঁড়াল। সামান্য উপচার, অতিসামান্য ওঁর পুজি। কিন্তু পূজায যার যেটুকু ক্ষমতা সে তাই নিয়েই সাঙ্গ করে, এও তাই। তার নির্মল পূজাব আগ্রহটুকুই ভগবান গ্ৰহণ করুন।
১৩৫৭ সালের ২৮শে ভাদ্র ওঁর জীবিতাবস্থায় শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল আমার মামাব বাসারাড়ি সুইনহো স্ট্রীটে। এই অনুষ্ঠানে বহু সাহিত্যিক বন্ধুবা এসেছিলেন ওঁর। শ্রদ্ধেয় উপেন-দা, বন্ধুবান্ধব মনোজ বসু, ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল, বেগম জাহান-আরা খান স্বামী সহ, গজেন ঠাকুরপো, সুমথ ঠাকুরপো ইত্যাদি।
এই জন্মদিনে গজেন ঠাকুরপোরা ওঁকে একখানা খাতা উপহার দেন– তার ওপর একটি কালো কীভাব লাগানো ছিল। সুন্দর করে বাঁধানো, তাতে সোনালী অক্ষবে ইংরাজীতে লেখা ছিল—’কাজল’। এ খাতাখানা আজও আমার কাছে আছে। সেই সময়েই ঠিক হয়ে যায়, ‘কাজল’ উনি লিখতে শুরু করবেন অবিলম্বে এবং তা ধারাবাহিকভাবে বেবুবে কোন পত্রিকায়। আমি জানতাম ‘কাজল’ উনি লিখবেন, যেমন জানতাম ‘ইছামতী’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড উনি লিখবেন, ‘অথৈ জল’ ও দ্বিতীয় খণ্ড লিখবার ইচ্ছে ছিল ওঁর। ওঁরই কাছে আরও শুনেছি ওঁর ‘দেবযান’ লিখবার ইচ্ছা ছিল পথের পাঁচালী লিখবারও আগে। কিন্তু লিখেছেন অনেক পরে। একটা খাতায় উনি দেৱ্যানের খানিকটা লিখে রেখেছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। এ লেখার বহু পরে উনি ‘দেবযান’ শেষ করেন–আমার বিয়েরও দু-তিন বছর পরে। তখন দেবযানের নাম ছিল “দেবতার ব্যথা’। ওঁর রচনার প্লট লেখা থাকত ছোট ছোট বইতে। তাতে উনি কী লিখবেন সামান্য কথায় তার স্কেচ করে রাখতেন। পরে ঐ স্কেচ দেখলেই ওঁর মনে পড়ত। উনি কী লিখবেন। ঐ সব বিভিন্ন চরিত্রের বহু ঘটনার সামান্য টুকরো ও নানা লেখার খসড়া আজও আমি রেখে দিয়েছি যত্ন করে আমার কাছে। তাতে কত কী লিখবার, কত কী জানিবার আগ্রহ ছিল ওঁর, তার পরিচয় পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়, কত কী পড়েছিলেন উনি তার আভাস। উনি যেন ছিলেন চিরদিনের ছাত্র-প্রকৃতির এই মহিমময় অনন্ত ঐশ্বর্যভরা পরিবেশ, এর ভিতরে আত্মহারা ছিলেন তিনি। প্রকৃতিপাগল বিভূতিভূষণ। ঘাটশিলায় ওঁর মৃত্যুর পাঁচ-ছ দিন আগে বেলাশেষে আমি বসেছিলাম আমাদের বারান্দার চওড়া সিঁড়ির ওপর। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। বাবলু উঠোনের ঘাসের ওপর ওর বাবাকে নিয়ে খেলছিল। আজও বড় বেশি করে সেই দিনটির কথা, সেই অপরাহ্ন। বেলাটির কথা আমার মনে পড়ে।
উনি সেসময়ে আমাকে বললেন-তুমি আমার দিকে একদম নজর দাও না। আমি কখন কী করি বল তো? এদিকে আমার কাজল’ শুরু করতে হবে। বাবলুকে নিয়ে কী যে করি! তুমি শুধু শুধু বাবলুকে আমার কাছে দাও।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! সে কী গো, আমিই বরং ছেলেটাকে কাছে পাই নে, শুধু তুমি ওকে নিয়ে ঘুরছে কোথায় কোথায়। ওরা দুর্বল স্বাস্থ্য-কোথায় আমি ভাবছি, ওরা কী স্বাস্থ্য টিকবে।
চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন উনি।–আর বেড়ানো নয়, কী বল? খুবই বেড়ানো হযেছে। পুজোর ভেতর অত্যন্ত বেড়ালাম, কী বল? বেড়ালাম না?
আমি চুপ করে রইলাম। এমন ভ্ৰমণ-বাতিকগ্রস্ত লোক আমি জীবনে দেখিনি। ছেলেপুলেদের যেমন মিষ্টি ও খেলনার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করা যায়, এই বালকস্বভাব। ভদ্রলোকটিকে বেড়ানোর নামে যেখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত, যদি জানতে পারতেন সেখানে দেখবার কিছু আছে।
উনি নিজেই আবার বললেন–এইবার লেখা শুরু করি, কী বল? পুজোতে ওরকম সবাই একটু-বুঝলে না? সব বন্ধুবান্ধব এক জায়গায় হওয়া, আমোদ হয় না? কী বল? কাল আমাকে খুব ভোরে তুলে দেবে, বুঝলে?
আমি হাসলাম। তোমার চাইতে ভোরে উঠাব আমি? তোমার চোখে কী ঘুম আছে? আমার তো মনে হয় না।
ওঁরই ডাকে ঘুম ভাঙল সেদিন আমার-ওঠে, ওঠে। গেট খুলে দাও। আমি ‘কাজলে’ব ছক তৈরি করব না। আজ? মনে নেই? ওঠে, দেরি হয়ে যাবে।
আমি ঘুম-জড়ানো চোখে বাইরের দিকে তোকালাম।–রাত রয়েছে যে, আর একটু পরে যাও। যাবে বনে পাহাড়ে, ওখানে তো সদাই নির্জন।
উনি বললেন-না, উপাসনা সেরে নেব না। আমার সেই শিলাসনে? তারপরে লেখা।
আমি জানতাম, উনি ‘ফুলডুংরি’র পেছনে বনের ভেতর একটি বিরাট পাথরেব ওপর বসে লিখতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন ওখানে মাঝে মাঝে, উপাসনা করতেন। সে সব কত কথা, কত স্মৃতি।
তখনও জানি না, কী করাল মেঘ ঝুলছে আমার মাথার ওপর-গর্ভে তার বজ্রাগ্নি লুকিয়ে নিয়ে। সেইদিনই যে আমার জীবনের চরম দিন, তার কিছুমাত্র আভাস পাইনি। আমি।
সকাল সকাল ফেরা ওঁর হল না। উনি ফিরলেন একেবারে বেলা সাড়ে-দশটা এগারোটায়। আমি তখন রান্নায় ব্যস্ত।। ওঁকে দোর খুলে দিলাম। উনি বললেন-প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে আমার।
ওঁর খাবার করাই ছিল। বিছানার উপর বসলে ওঁকে খাবার এনে দিলাম।
উনি সেই খাবারটুকু খেয়ে আমাকে বললেন-আবও কিছু দাও। কী আছে তোমার?
আমি বললাম-নারকেল-চিড়ে খাও। তুমি ভালোবাস।
নারকেল-চিঁড়ে দিয়ে আমি আবার রান্নায় ফিরে গেলাম।