- বইয়ের নামঃ কাজল
- লেখকের নামঃ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০. ভূমিকা ও বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট
ভূমিকা
উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে যিনি আমার পিছনে মাভৈঃ বাণী নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই মা আমাকে সর্বক্ষণ উৎসাহ দিয়েছেন, পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়েছেন। আমার এবং তঁর পরিশ্রম সমান সমান।
অনেক বিনিদ্র রাত্রির ইতিহাস রয়ে গেল এ বইয়ের পেছনে। লিখতে লিখতে মনে হয়েছে। পাঠকদের কথা, জানি না তারা একে কেমন ভাবে নেবেন। তঁদের জন্যই আমার পরিশ্রম, তারা গ্ৰহণ করলে আমি ধন্য হবো।
তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
আরণ্যক, ব্যারাকপুর
বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট
১৯৪০ সনের ৩রা ডিসেম্বর আমার বিয়ে হয়। সে সময়ে উনি ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীটের ‘প্যারাডাইস লজে’ থাকতেন। আমার বিয়ের প্রায় একবছর পরে ঐ মেসের বাস তিনি উঠিয়ে দেন।
ঐ মেসে ছিলেন উনি বহুদিন, কাগজপত্র বইখাতা জিনিসপত্র জন্মেছিল ওখানে অপর্যাপ্ত। মেসের বাস যখন তুলে দেন তখন তার কিছু জিনিস উনি পাঠিয়ে দেন ঘাটশিলায়, কিছু আমাদের দেশের বাড়ি গোপালনগর বারাকপুরে।
ঘাটশিলার যে ঘরে আমি শূতাম তার পায়ের দিকের দেওয়ালে টাঙানো ছিল ভারি সুন্দর একটি শিশুর ছবি, অপূর্ব ছবিটি। খয়েরী রংয়ের সঙ্গে সাদা মেশানো বিলিতি ছবি। নিচে ইংরেজিতে ছবিটির নাম লেখা ছিল—‘বাবলাস’। ছেলেটির কোলের উপর একটি বাটিতে কিছু সারানগোলা জল। একটি কাঠিতে ফু দিয়ে ছেলেটি বুদবুদ তৈরি করছে।
ওঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কোনও বিলাতি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ক্যালেন্ডার ওটা। উনি ছবিটি আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ঐ ছবি দেখেই নাকি উনি কাজলের চরিত্র কল্পনা করেছিলেন। অমন নিম্পাপ, দেবদুর্লভ কৃপবান, কোমল, সুন্দর ছেলেটি-কাজল নাকি ওঁর কল্পনায় ঐ রূপেই ছিল।
উনি নিজে আমাকে বহুদিন বলেছেন, একসময়ে নাকি উনি সস্তান-সস্তান করে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বহু লোকের কাছে শুনেছি, অনেককে উনি নাকি বলতেন—আমাকে বাবা ডাকবি?—ডাক্না।
আরও শুনেছি, এই পিতৃ-সম্বোধন শুনবার জন্য নানাপ্রকার ঘুষও দিতেন। কাউকে কাউকে।
আজ আরও অনেক কথাই মনে পড়ছে। ওঁর ধর্ম মেয়ে, নাম তার রেণু। রেণুর উল্লেখ আছে ওঁর অনেক বইতে, ওঁর দিনপঞ্জিগুলিতে। ওঁর ‘বিচিত্র জগৎ’। বইখানা রেণুকে উৎসর্গ করেছিলেন। রেণুর সঙ্গে ওঁর মেহের সম্পর্ক গভীর ছিল। রেণুকে নিয়েই ওদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর গভীর পরিণতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবতী কালে ওদের সকলের সঙ্গেই ওঁর আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।
আমার বিয়ের পরে রেণু এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে।
রেণু আমাকে ডাকত মা-মণি বলে, ওঁকে বলত বাবা। রেণুর সঙ্গে ওঁর মাঝে মাঝে দেখা হত কলকাতায়। রেণু তখন কলকাতাতেই ছিল।
বাবলু যখন একবছরের, সে সময় একদিন একটি নিরেট লোহার সুন্দর মোটরগাড়ি এনে বাবলুকে দেন। উনি বলেন, তোর দিদি দিয়েছে-রেণুদিদি।
কাজল সম্বন্ধে উনি কী লিখবেন, তার কিছু কিছু আভাস অপরাজিত বইতে পাওয়া যায়। ওতেই বীজাকারে কাজল সম্বন্ধে সকল কথাই প্রায় বলা আছে। তারপর যে তঁর কল্পনার কাজলকে বাস্তবে রূপ দেবে, প্রতিমার কাঠামোর ওপর খড়-বিচালি বেঁধে মাটি ধরিয়ে রং-তুলির স্পর্শে সেই প্রতিমাকে সঞ্জীবিত করবে, সে দায়িত্ব তার। গল্পকে টেনে নিয়ে যাবার, উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব লেখকের, বিভূতিভূষণের অসমাপ্ত রচনা যে সমাপ্ত করবে তার। তিনি জানতেন না ভবিষ্যতে এই কাজ করবে তারই পুত্র।
কাজল উপন্যাস সম্পর্কে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে আকাশের নব নব ছায়াবুপ দেখতে দেখতে, সন্ধ্যাবেলায় বিলবিলের ধাবে ঠেস দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে করতে আলোচনা করেছেন। কাজল এখন কত বড় হয়েছে, কী করছে, কী ভাবছে, এসব আলোচনা করতেন। বাবলু (তারাদাস) হওযার পরে মুহূর্তে মুহূর্তে বাবলুকে দেখা চাই। বাবলু কী করছে, কেমন অঙ্গভঙ্গি করছে।–সর্বদা বাড়ির সকলকে ডেকে দেখাতে ভালোবাসতেন। সর্দার খেলুড়ের সঙ্গে বাবলু যেন ছিল শিশুখেলুড়ে। বুঝতে পাবতাম, কাজল উপন্যাসের পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে। কাজল উপন্যাস সম্বন্ধে বহু নোট নিতেন। কিছু কিছু লিখেও ছিলেন। ওঁর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য, এবং এই উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যবধানে বিশেষ কিছু বক্ষণ করতে পারি নি।
বাবলু যখন একটু বড় হল এবং স্কুলে যেতে শুরু করল, তখন সে বাবার কথা শুনতে চাইত। তার লেখার বিষয়, তঁরা ভালো-লাগা, তার জীবনচর্চা ও জানতে চাইত। তন্ময় হয়ে শূনত এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইত সব কিছু। দীর্ঘদিন বাবলুর সঙ্গে ওঁর স্মৃতিতর্পণ করতে করতে কাজল উপন্যাস সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছি। বাবলুর তখন থেকেই আগ্রহ ছিল “কাজিল’ লিখবার। অস্তরে অস্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। তার হাযার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে একেবারে একটানা অবসব, সে অবসর কী করে কাটবে এই ভাবনায় যখন অস্থির হয়ে উঠেছিল, তখন নিজেই একদিন আমায বলল–মা, কাজল’ লিখতে শুরু করি। তুমি কী বল? আমি সেদিন ওকে মুখে উৎসাহ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, লেখ, চেষ্টা কর। চেষ্টার অসাধ্য কী আছে।